সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী আজিজ খান, বাংলাদেশে জালিয়াতির শীর্ষে

লুটপাট করতে যত রকম চাতুরতা, জালিয়াতি ও অপকৌশল রয়েছে সব প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া খ্যাত মুহাম্মদ আজিজ খানের বিরুদ্ধে। কখনও হুমকি দিয়ে কখনও বিদ্যুৎ বিভাগকে জিম্মি করে টাকা হাতিয়ে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীতে পরিণত হয়েছেন।

জনগণের দৃষ্টি ফাঁকি দিতে নো-ইলেকট্রিসিটি নো প্রেমেন্ট পদ্ধতিতেও সূক্ষ্ম জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রথম চুক্তিতে বিনিয়োগ তুলে নিলেও মেয়াদ বৃদ্ধির সময় ফের বিপুল পরিমাণ ভাড়া আদায় করেছেন রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। এভাবে একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র কয়েক দফায় বিক্রি করার তথ্য পাওয়া গেছে। কয়েক দফায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে যখন তীব্র সমালোচনা চলছিল। তখন জালিয়াতির নতুন কৌশল অবলম্বন করেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ আজিজ খান।

চুক্তিতে বলা হয়, নো-ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট অর্থাৎ বিদ্যুৎ দিলে ভাড়া পাবে না দিলে নেই। পুরনো অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো স্বাভাবিকভাবে বসে থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যৌথ কারসাজির মাধ্যমে প্রায় সময়ই সচল থেকেছে সামিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর যেহেতু বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে সে কারণে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও গুণতে হয়েছে কাড়ি কাড়ি ডলার। সামিট গ্রুপকে সুবিধা দিতে অনেক সময় সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখার তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশি টাকায় বিনিয়োগ হলেও ডলারে বিল নিয়েছেন আজিজ খান। বাংলাদেশ যখন ডলার সংকটে ধুঁকছে তখনও সামিটের সঙ্গে নতুন করে ডলারে চুক্তি করা হয় ২০২২ সালে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিদায়ী ৩ বছর টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা বাড়তি পরিশোধ করতে হয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বিপদে ফেলে টাকার কুমির বনে গেছেন কয়েকটি কোম্পানি।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুতের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা যখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন দফায় দফায় সামিট, ওরিয়ন ও ইউনাইটেড, কনফিডেন্স গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। একবার ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব এলে প্রয়োজনীয়তা না থাকায় সেগুলো নাকচ করে দেওয়া হয়। তারপরও বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে চুক্তি নবায়ন করা হয়।

পাঁচ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব বাতিল প্রসঙ্গে বিইআরসির সাবেক সদস্য মকবুল ই-এলাহী চৌধূরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কোনটি ৩ ,কোনটি ৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে ছিল। প্রথম চুক্তির সময় তার যতো ক্যাপিট্যাল বিনিয়োগ ছিল দেওয়া হয়েছে। মেয়াদ শেষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দাম শূন্য হয়ে যায়, তখন পুরনো চুক্তি কি করে নবায়ন হয়। যে কারণে তখন বাতিল করে দেওয়া হয়।

২০২২ সালের আগস্টে সামিটের পুরনো ৪টিসহ মোট ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ছিল সামিটের নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাধবদী ১১ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের যৌথ মালিকানাধীন যশোর ৪০ মেগাওয়াট (ফার্নেস অয়েল) বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গোয়ালপাড়া ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। খোদ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আপত্তির পরও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন করা হয়।

সামিট ও ইউনাইটেড গ্রুপের যৌথ মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ইউনিট-২ ঢাকা স্টক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৯ সালে। প্রথমে ৫ বছরের জন্য চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তিতেই মুনাফাসহ বিনিয়োগ তুলে নেয় কোম্পানিটি। ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক গোয়ালাপাড়া ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চুক্তি কয়েক দফায় নবায়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২২ আগস্ট ২ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। নবায়নের শর্ত দেওয়া হয় নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট।

গত ২৭ জুলাই দেখা গেছে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে সামিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ডে-পিকে ৪৮ মেগাওয়াট এবং সান্ধ্যকালীন পিকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেওয়া হয়। যশোর ৪০ মেগাওয়াটের ক্ষেত্রেও একই নজির দেখা গেছে। সামিট গ্রুপের যশোর বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তখন একই জোনে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির মধুমতি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়।

একই সময়ে মদনগঞ্জ ১০২ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তিও ২ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। সামিট গ্রুপকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ জোনের সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ২৭ জুলাই ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো হয়। এই চিত্র প্রায় নিত্যদিনের বলা চলে।

কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগে চালানো হবে, সেজন্য একটি তালিকা রয়েছে যাকে বিপিডিবির ভাষায় মেরিট অর্ডার বলা হয়। এই তালিকার ভিত্তি হচ্ছে সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগে চালাতে হবে। এরপর চাহিদা বাড়লে সে অনুযায়ী ধাপে ধাপে বেশি খরচের কেন্দ্রগুলো চালানো হবে। এই তালিকায় প্রথমে থাকে জলবিদ্যুৎ, এরপর যথাক্রমে গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস অয়েল। সে হিসেবে সবার শেষে থাকার কথা সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। কিন্তু সবাইকে ডিঙিয়ে রহস্যজনক কারণে উপরের দিকে থেকেছে সামিটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এখানেই সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী আজিজ খান কেরামতি দেখিয়েছেন।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিওএমপি (ভেরিয়েবল অপরেশন এন্ড মেইটেনেস প্রাইস) খরচ কৌশলে কয়েক পয়সা কম দেখানো হয়। আর তাতে অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে পেছনে ফেলে দেন আজিজ খান। যাতে ক্যাপাসিটি চার্জ পেতে সহজ হয়। এতে বিপিডিবি মারত্মাকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েক পয়সা কম দেখিয়ে সামিট থেকে বিদ্যুৎ নেওয়া হয়েছে। নর্থওয়েস্টের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলে ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে, আর সামিট পেতো না। বিপিডিবির এই কৌশলে দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। ২০২২ সালের ২২ আগস্ট এক আদেশে সামিট গ্রুপের ৪টি, ওরিয়ন গ্রুপের ১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, এখনকি চলছে না! ঠিকই চলছে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অনেক বিকল্প ছিল, কিন্তু বিপিডিবি অনেক সময় বাধ্য হয়েছে উপরের নির্দেশ মেনে চলতে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যানও তাই বলে। ২০২২ সালে যখন মেয়াদ বাড়ানো হয়, সে বছর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে প্রকৃত উৎপাদনের গড় মাত্র ১০ হাজার ৯৭ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০.৫৩ শতাংশ মাত্র। অলস বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৬০ শতাংশ হলেও সামিট, ওরিয়ন, ইউনাইটেডের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নবায়ন করা হয়েছে।

শঙ্কার কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্টের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঠিকই গুনতে হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২ দশমিক ১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ৩ দশমিক ১৬ টাকা আর ২০২২ সালে সাড়ে ৮ টাকা, এখন গড় উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

ওই ৬ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নবায়নের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়, সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, রিলায়েবিলিটি বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, যারা বলছে ফ্রিকোয়েন্সির জন্য ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, তারা জনগণকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে, অথবা তারা মূর্খ। প্রকৃত অর্থে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সরকার সমর্থিত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা দেওয়ার জন্য। বিশেষ আইনে এসবের মেয়াদ আগেও বাড়ানো হয়েছে।

একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাতকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন সামিট গ্রুপ। দেশের টাকা লুটে সিঙ্গাপুরে টাকার পাহাড় গড়েছেন।দেশীয় কোম্পানি সামিট রাতারাতি সিঙ্গাপুরের কোম্পানি হয়ে গেলো কয়েক বছরে। আগে দেশে ডলার দিতাম, এখন সিঙ্গাপুরে ডলার পৌঁছে দিচ্ছি। আজিজ খান ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে বিপদগ্রস্ত করেছেন। সিঙ্গাপুরের শীর্ষস্থানীয় ধনী আজিজ খানকে বাংলাদেশের শীর্ষ জালিয়াত মনে করেন অনেকে। তারা মতো এতো অভিনব পন্থায় কেউ লুটপাট করেছে কি-না সন্দেহ রয়েছে।