মানুষের ব্যক্তিত্বের ছাপ অনেক সময় তার শরীরের ঘ্রাণেই গেঁথে থাকে। ফ্যাশনপ্রিয় মানুষের কাছে পারফিউম বা সুগন্ধি এক নৈশব্দের ভাষা, যা পরিচয় দেয় রুচির, সময়চেতনার আর নিজস্বতার। কিন্তু প্রেম জমে ওঠার আগেই যদি সুগন্ধিকে কঠিন কোনো রহস্য মনে হয়, তবে তার নান্দনিকতাও অধরা থেকে যায়। তাই আমরা সুগন্ধির রাজ্যে প্রবেশের আগে জেনে রাখার মতো বিষয়গুলোর অল্প একটু জেনে নেয়ার চেষ্টা করবো।
সুগন্ধি ব্যবহারে প্রথমেই খেয়াল রাখতে হয় গন্ধটি কি পুরুষালি, মেয়েলি, নাকি নিরপেক্ষ? এছাড়া, কোন অনুষ্ঠান বা পরিবেশে আমরা এটি ব্যবহার করতে যাচ্ছি সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আর বিয়ের অনুষ্ঠানে একই পোশাকে যাওয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি একই পারফিউমও সব জায়গায় ব্যবহার করা যায় না।
ঋতু কিংবা দিনের সময়ের পরিবর্তনেও সঙ্গেও পারফিউমের প্রভাব ও কার্যকারিতায় ভিন্নতা দেখা দেয়। কাজেই, আমাদের সুগন্ধি গ্রীষ্ম, বর্ষা বা শীত কোন ঋতুর জন্য উপযুক্ত, তা জেনে রাখা ভালো। একই সাথে, দিনের আলোয় নাকি রাতের আঁধারে কোন সময়টা ব্যবহারের জন্য ঠিক এ বিষয়েও একটুখানি ধারণা রাখা উত্তম।
এখন এতোগুলো বিষয় পারফিউম সম্পর্কে জানবো কীভাবে? চিন্তা নেই, অনলাইন দুনিয়ার কিছু সাইটসেই আছে এইসব তথ্যাদি, যেখানে যেকোনো পারফিউমের নোটস, স্থায়িত্ব, বিস্তার, লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
এই সাইটগুলোতে অবশ্যই যেকোনো পারফিউম কেনার আগে ঢুঁ মেরে আসা উচিত। ফ্র্যাগরেগান্টিকা ডট কম, বেস নোটস ডট নেট ও পারফিউমো ডট নেটসহ আরও অনেক সাইট থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
পারফিউমের জগতে কিছু শব্দ বারবার দেখা যায়। এসব শব্দ একটি সুগন্ধির গভীরতা, স্বভাব এবং স্থায়িত্ব বোঝায়। এমন কিছু বহুল ব্যবহৃত শব্দের সঙ্গে আমরা একটু পরিচিত হয়ে নিই-
যেমন, নোট। পারফিউমে ব্যবহৃত বিভিন্ন সুগন্ধি উপাদানকে বলা হয় ‘নোট’। সাধারণত টপ নোট, মিডল নোট ও বেস নোট এই তিন স্তরে বিভক্ত নোটগুলো মিলে তৈরি হয় এক অনন্য ঘ্রাণ অভিজ্ঞতা।
স্প্রের পর প্রথম যে ঘ্রাণ নাকে আসে, সেটাই টপ নোট। এটি হালকা, সতেজ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে যায়।
হার্ট নোট বা মিডল নোট হলো টপ নোট মিলিয়ে গেলে যে ঘ্রাণটি ফুটে ওঠে, সেটি। এটি সুগন্ধির মূল চরিত্র। এই ঘ্রাণ থাকে দীর্ঘক্ষণ এবং পারফিউমের আবেগটাকেও ধরে রাখে।
বেস নোট হলো ঘ্রাণের সবচেয়ে গভীর স্তর, যা টিকে থাকে সবথেকে বেশি সময় ধরে। একাধিক নোটের সুনিপুণ মিশ্রণে তৈরি হয় একোর্ড। আবার হয়তো অনেকেই খেয়াল করে দেখেছেন যে সুগন্ধি দেয়ার পর ব্যবহারকারী সেখান থেকে চলে গেলেও ঘ্রাণের ছাপ রয়ে যায়। এটিকে বলে সিলিয়েজ।
ডুপ ডিজাইনার বা দামি ব্র্যান্ডের ঘ্রাণের অনুকরণে তৈরি তুলনামূলক সস্তা পারফিউম, যার ঘ্রাণ অনেকটাই মিল রাখে মূল পারফফিউমটির সঙ্গে।
শব্দগুচ্ছ জানা হলো, সুগন্ধির ভাষায় প্রথম পাঠ সম্পন্ন। এবার চলুন পরিচিত হই সেই সব নামের সঙ্গে যারা ঘ্রাণের জগতে একেকটি কিংবদন্তি। পারফিউমের জগতে ব্র্যান্ডই যেন হয়ে ওঠে ঘ্রাণের একেকটি অধ্যায়। এখানে আছে রাজকীয় দামি ডিজাইনার ব্র্যান্ড, শিল্পমনা ব্র্যান্ড, আবার রয়েছে সুলভ মূল্যের প্রতিদিনের সঙ্গীও। প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারি আমরা।
প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে যারা সুগন্ধিকে রীতিমতো শিল্পের জায়গায় তুলে এনেছে, তাদেরই বলা হয় পারফিউম হাউস। এরা জনরুচির কথা না ভেবে তৈরি করে নিজেদের স্বতন্ত্র, গভীর ও রহস্যময় ঘ্রাণ। হয়তো সবার পছন্দ হবে না, তবে যারা পছন্দ করবেন তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠবে সেসব সুগন্ধি।
অনলাইন কন্টেন্ট নির্মাতাদের অনুসরণ করে পারফিউম সম্পর্কে সহজেই জানা যায়। ইউটিউব, ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে পারফিউম বিষয়ক অসংখ্য রিভিউ, ঘ্রাণ বিশ্লেষণ এবং গাইড পাওয়া যায়, যেগুলো নতুনদের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
এইসব কন্টেন্ট নির্মাতারা শুধুই সুগন্ধির প্রেমিক নন তারা ঘ্রাণকে ব্যাখ্যা করতে জানেন, জানেন কিভাবে সেটি আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিশে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অজস্র জনপ্রিয় কন্টেন্ট নির্মাতাদের মাঝে কয়েকজন হলেন- জেরেমি ফ্রেগরেন্স, কার্লি ফ্রেগরেন্স, স্কুল অফ সেন্ট, জেন্টস সেন্টস, ম্যান ফর হিমসেলফ, দ্য সেন্টেন্ড । বাংলাদেশের প্রতিভাবান কন্টেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে আছেন জয় আমিন, মেহেদি হাসান, সুস্ময় অফিসিয়াল, পারফিউমোলোজি বিডিসহ আরও অনেকে।
সুগন্ধি নিছকই একটি প্রসাধনী নয়, এটি এক ধরনের আত্ম-অভিব্যক্তি। নিজের ভেতরের রুচি, আবেগ আর উপস্থিতিকে প্রকাশের সূক্ষ্ম মাধ্যম এটি। সুগন্ধির জগৎকে জানতে জানতেই গড়ে ওঠে নিজের সঙ্গে এক নীরব বন্ধন। এই জানার পথে আমরা শুধু পারফিউম নয়, নিজেকেও নতুন করে চিনে নিই। আর নিজেকে চেনার সেই সৌন্দর্যেই লুকিয়ে থাকুক আমাদের ভালো থাকার গভীর আনন্দ, সর্বোপরি এটিই প্রত্যাশা।