বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় জনগণকে কার্যকরভাবে প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারছে না। বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো অত্যন্ত প্রকট। যথাযথ কর্তৃত্ব, জনবল, আর্থিক সামর্থ্য ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে মূলত এসব সমস্যা হচ্ছে। সংসদ সদস্য-উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান-ইউএনওÑ এ ত্রিমুখী টানাপোড়েনে উপজেলা পরিষদ যথাযথভাবে কাজ করছে না। জেলা পরিষদের কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণের কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। সার্বিক সমন্বয়ের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কেই জেলা পরিষদে পরিণত করা দরকার। সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের ‘নগর সরকার’ গঠনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
বৃহস্পতিবার, ঢাকার জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট-এনআইএলজি মিলনায়তনে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন-এর সহায়তায় গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম ও ইউএনডিপির যৌথ আয়োজনে ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জন-আকাঙ্খার আলোকে স্থানীয় সরকার সংস্কার’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব বলেন।
গভর্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী’র সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেব উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক, সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সোহেল ইবনে আলী। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্যদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মাশহুদা খাতুন শেফালী, নির্বাহী পরিচালক, নারী উদ্যোগ কেন্দ্রও ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বর্তমান ও সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, নারী, পেশাজীবী, গণমাধ্যম কর্মী, উন্নয়ন কর্মী, সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, যুব প্রতিনিধি, ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক, আদিবাসী, দলিতসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এতে উপস্থিত ছিলেন।
ফোরামের সদস্য আমানুর রহমানের সঞ্চালনায় এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা এবং গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের ফ্যাসিলিটেটর অনিরুদ্ধ রায়।
প্রশাসন চাঁদাবাজির অংশীদার উল্লেখ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম ও ইউএনডিপির এ যৌথ উদ্যোগ সংস্কার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করছে এবং আমরা একটি চিন্তার ঐক্য দেখতে পাচ্ছি। সরকার ঐকমত্য কমিশন গঠন করায় ইতিমধ্যে আমরা ২১০টি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছি। বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। আমরা প্রস্তাব করতে যাচ্ছি, ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়ানোর জন্য, যেটা জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০টি পর্যন্ত হতে পারে।
ড. তোফায়েল বলেন, পার্বত্য এলাকার জেলা পরিষদের নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ সেল গঠন করতে হবে। জেলা পর্যায়ে একটি ১০ সদস্যের অধিদপ্তর সব ধরনের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, কমিশন জেলা পরিষদ আরো শক্তিশালী করার প্রস্তাব করেছে। জেলার অধীনে সব সরকারি সেবা দপ্তরগুলো হস্তান্তর করতে হবে। জেলা হবে পরিকল্পনা ইউনিট, যার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে জাতীয় পরিকল্পনার। উপজেলা ও ইউনিয়ন হবে বাস্তবায়নকারী ইউনিট। সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো একইরকম হবে। আমরা যদি স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে পারি তাহলে সচিবালয় ৫০% শতাংশ দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
সভাপতির বক্তব্যে মহসিন আলী বলেন, গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম ২০০৭ সাল থেকে প্রায় পঞ্চাশটির অধিক সংগঠন নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার বিষয়ে এডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ২০০৭ সালে কনভেনশনের মাধ্যমে ফোরাম যে ৪০ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করে তার বেশিরভাগই পরবর্তীতে প্রণীত আইনগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার কমিশন কার্যকর না করা এবং সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা রাখার বিধানের ফলাফল ভালো হয়নি। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার সংস্কার উদ্যোগে সহায়তা করার জন্যই ফোরামের এ প্রয়াস। স্থানীয় সরকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি সংস্কার কমিশন ও ফোরামের এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য।
সম্মানীয় অতিথির বক্তব্যে আনোয়ারুল হক বলেন, আমদের লক্ষ্য এ সংস্কার কমিশনে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সংস্কার করে জন-বান্ধব করে শক্তিশালী করতে হবে জন-আকাক্সক্ষা পূরণে। মাশহুদা খাতুন শেফালী বলেন, আমরা ফোরামের সাথে একমত যে, এক-তৃতীয়াংশ আসনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী সদস্যদের নির্বাচন হতে হবে। ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। জনআকাক্সক্ষার আলোকেই আমাদের সংস্কার কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে ৫০টির মতো আলোচনা সভা করেছি বিভিন্ন অংশীজনের সাথে। ৪৬ হাজার ৬৮০টি জনমত জরিপ করেছি বিবিএসের সহায়তায়। কমিশনের প্রস্তাবনা জমা দেয়ার পরে এ ফোরাম নিশ্চয়ই ফলো-আপ কার্যক্রম রাখবে। সেখানেও আমরা ভূমিকা রাখতে চাই।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলা হয়, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় মোটা দাগে যে ছয় ধরনের সীমাবদ্ধতা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো হলো: প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, জেন্ডার ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির সীমিত সুযোগ। এ প্রেক্ষিতে যেসব সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় সেগুলো হলো: স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও দায়িত্ব বিভাজন প্রস্তাবের অধীনে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদের ৯টি ওয়ার্ড জনসংখ্যা অনুপাতে ১২টি ওয়ার্ডে উন্নীত করা; উপজেলা পরিষদে সংসদসদস্যদের উপদেষ্টার ভূমিকা সম্বলিত বিধান বাতিল করা; সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকা ও দায়-দায়িত্ব সুস্পষ্ট করা; জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে রূপান্তর করা এবং জেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন একজন জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার ক্যাডার সার্ভিস চালু করা ইত্যাদি।
সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অধীনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার বিভাগে একটি নিবেদিত গবেষণা, ডকুমেন্টেশন ও নীতি তথ্য ভান্ডার স্থাপন করা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে এনআইএলজির কাজের পরিধি বাড়ানো ও বিকেন্দ্রগুলো বাস্তবায়ন এবং স্থানীয় সরকারের আর্থিক মঞ্জুরি, অডিট, তদারকি ও মনিটরিংসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্য-পরিধি নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়নের জন্য অবিলম্বে একটি স্থায়ী স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন ও কার্যকর করা ইত্যাদি।
অংশগ্রহণকারীরা মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে যেসব সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করা; প্রার্থীদের ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা করা; চেয়ারম্যান-মেয়রদের একক ক্ষমতার চর্চা হ্রাস করা; স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্মানী বাড়ানো।