স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় যুব-তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায়

স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক জননীতি তৈরিতে যুবসমাজকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভাবনাগুলো তুলে ধরতে পারলে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের পথ মসৃণ হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।


আজ বৃহস্পতিবার, ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশস্থ সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সহায়তায় গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম ও ইউএনডিপির যৌথ আয়োজনে যুব প্রতিনিধিদের সাথে ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জন-আকাক্সক্ষার আলোকে স্থানীয় সরকার সংস্কার’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব বলেন।

এতে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন ফোরামের সচিবালয় ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক নাসিফা আলী। ইউএনডিপির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যানালিস্ট সাওসান সুহা। ওয়েভ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কানিজ ফাতেমা’র স্বাগত বক্তব্য ও সঞ্চালনায় এতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, নাগরিক সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, যেমন- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বিওয়াইএলসি, ইয়ুথ এসেম্বলি, ইয়ুথ এনগেজমেন্ট এন্ড সাপোর্ট (ইয়েস গ্রæপ), ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (ওয়াইএএসডি), ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ডিবেটিং ক্লাবসহ আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যুব প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

আরও পড়ুনঃ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের আহ্বান


স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ে ফোরামের বক্তব্য উপস্থাপন করেন ফোরামের ফ্যাসিলিটেটর ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদানকালে নাসিফা আলী বলেন, তরুণরাই পরিবর্তনের ধারক ও বাহক। ওয়েভ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরুর পর থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নিরলসভাবে সামাজিক উন্নয়নে বহুমুখী কাজ করে আসছে।

৭টি কর্মসূচির মধ্যে সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা কর্মসূচির কার্যক্রমগুলো সুশাসন নিশ্চিতকল্পে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই কর্মসূচির একটি অন্যতম নেটওয়ার্ক হলো ‘গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরাম’। ইতোমধ্যে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে এ নেটওয়ার্ক কাজ করছে। ওয়েভ ফাউন্ডেশন ২০১০ সালে ইয়ুথ প্লাটফরম গঠন করে যা ২০১৫ সাথে ইয়ুথ এসেম্বলি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।


এই ইয়ুথ এসেম্বলি বর্তমানে যুবসমাজের অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাগত বক্তব্যে কানিজ ফাতেমা বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা কর্মক্ষম জনসংখ্যাধিক্যে অবস্থান করছে। দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৩৩% যুব, যাদের বয়স ১৮-৩৫ বছর। আমাদের জাতীয় ইতিহাস যুবসমাজের গৌরবদীপ্ত স্তম্ভেও উপর দাঁড়িয়ে। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের যুব সমাজের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। পরবর্তীত স্বৈরাচার-সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও গণতন্ত্রের সৈনিক হিসেবে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের যুবসমাজ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারি হিসেবে তরুণসমাজই বিকেন্দ্রীকরণের ধারায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে সহায়ক ও অগ্রবর্তী শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। সাওসান সুহা বলেন, দেশের যেকোন দুর্যোগে এবং প্রয়োজনে তরুণরাই সবার আগে এগিয়ে আসে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বিশেষ করে সিদ্ধান্তগ্রহণে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করে যুব প্রতিনিধিরা যেসব উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরেন সেগুলো হলো: মেগা সিটিগুলোতে বিদ্যমান স্থানীয় সরকারগুলো কীভাবে কাজ করবে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে; আমাদের বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সংস্কারের ভাবনা ভাবতে হবে। যুব-তরুণরা কি স্থানীয় সরকারকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করে? স্থানীয় সরকারের হাতে তার বাজেট হস্তান্তর করতে হবে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকতে হবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় ই-গভার্নেন্সের পাশাপাশি নাগরিক সনদ প্রকাশ করতে হবে; দলিত সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো সমাধানে বা তাদের সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কী ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে; দলিত তরুণদের জন্য নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে; গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জনগণের মাধ্যমে সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করতে হবে; স্থানীয় সরকার সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনি কাঠামো ও নাগরিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করতে হবে; স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তরুণদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও ছায়া নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে; বছরভিত্তিক জন-আলোচনার মাধ্যমে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে; আদিবাসী তরুণদের নেতৃত্বের সক্ষমতা বিকাশে কাজ করতে হবে।

পাহাড়ে সেনা নিয়ন্ত্রণহীন প্রকৃত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে; দলীয় প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচনের পরিবর্তে পুর্বের কাঠামোতে ফিরে যেতে হবে; পার্বত্য ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থার সাথে কীভাবে সমন্বয় করা হবে তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে; স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় স্টান্ডিং কমিটিতে যুবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে আলাদা স্টান্ডিং কমিটি গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; সম্পদের দিক থেকে স্থানীয় সরকারকে স্বনির্ভর হতে হবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অনিরুদ্ধ রায় বলেন, ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর প্রদান করেছেন এর প্রধান ৫১টি সুপারিশের মধ্যে ২৫টি সুপারিশ গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সুপারিশগুলোর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ অথবা যেগুলোর সাথে একমত/আংশিকভাবে একমত পোষণ করা যায়। স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অধিদপ্তর, সেবা ইত্যাদি বিষয়ক ২৩টি সুপারিশ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আরো অংশীজনদের নিয়ে পর্যালোচনার পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।


৩টি সুপারিশের কিছু বিষয় যেমন, স্থানীয় সরকারের গঠন-কাঠামো; পরিষদের সদস্য; জেলা পরিষদ: নির্বাচন পদ্ধতি বিষয়ে ফোরামের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্দলীয় নির্বাচনের সুপারিশ করে আবার ছায়া পরিষদ নেতা নির্বাচনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা কি শুধু আলঙ্কারিক পদ তৈরির জন্য? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিষদে ‘অবৈতনিক সদস্য’ কতটা বাস্তবসম্মত তা ভেবে দেখতে হবে।

স্থানীয় সরকারকে একই কাঠামোর অধীনে আনতে হলে আলাদা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি গভার্নেন্স এডভোকেসি ফোরামের সংস্কার প্রস্তাবের বিশেষ দিক হিসেবে দুটি প্রস্তাবের উল্লেখ করেন: জেলার সামগ্রিক কার্যক্রম তত্তাবধান এবং জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও সেবা প্রদানকারী দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে ‘জেলা পরিষদ কার্যালয়ে রূপান্তর’ করা। এক্ষেত্রে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তথা জেলা পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবেন একজন জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা; এবং বিদ্যমান জেলা পরিষদকে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে যুব ও নারীদের উদ্যোক্তা/ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি মার্কেটিংয়ের জন্য সহায়তা প্রদান করা।

ফোরামের পক্ষ থেকে যুবসমাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়: নাগরিক অধিকার ও সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাসে বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বোঝাপড়ার চর্চা অব্যাহত রাখা; ক্স স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো; ক্স রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার প্রস্তাবনা/নির্বাচনী ইশতেহারে স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ক সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি রাখার বিষয়ে উৎসাহিত করা; ছাত্র/যুব সংগঠনগুলোর এজেন্ডা/কার্যক্রম হিসেবে বিকেন্দ্রীকরণ ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা; ক্স নিজস্ব পরিসরে (সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি) বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণের অপরিহার্যতা বিষয়ে সোচ্চার হওয়া।

এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ