সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ব্যাংক লুটপাটের মূল নায়ক ছিল বিতর্কিত-সমালোচিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। কোম্পানিটি গত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার দখল করেছে। অবৈধ উপায়ে দখল করা এসব শেয়ার হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলে এবার গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকটির প্রাক্তন দুই শীর্ষ কর্মকর্তা।
গত ১৫ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ার এবং সাবেক পরিচালক শহীদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর বরাবার পাঠানো হয়েছে। এতে গভর্নরের কাছে তিনটি দাবির উপস্থাপনের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের বিগত দিনের অনিয়ম ও সার্বিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চিঠিতে তিনটি দাবির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, গত কয়েকবছরে এস আলম গ্রুপ নামে বেনামে এবং জোরপূর্বক ক্রয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার দখল করেছে। এসব শেয়ার যেন অন্য কোথাও হস্তান্তর করতে না পারে সে ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকের সম্পদ লুটপাটের প্রকৃত চিত্র যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে অবিলম্বে উপস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি এস আলমের নিয়োগকৃত পরিচালনা পর্ষদ বাতিল ঘোষণা করে ২০১৩ সালের মতো সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও সক্ষম পেশাদার মানুষের মাধ্যমে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে হবে।
জানা যায়, ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ দেশের এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে কাজ শুরু করে ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। যেখানে শুরু থেকেই বিদেশি বিনিয়োগের হার ছিল লক্ষ্যনীয়। প্রতিষ্ঠানকালীন সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের সাড়ে ২৮ শতাংশ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা এবং বাকি সাড়ে ৭১ শতাংশে ছিল বিদেশি উদ্যোক্তাদের অবদান। এতে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গও উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগ করেছিল। তবে ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসার পর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। সেসময় ৭টি অস্তিত্বহীন শেল কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাংকের ১৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে চট্টগ্রামভিত্তিক এ কোম্পানি। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সহযোগিতায় ব্যাংকটিকে দখল করে বসে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংক দখলের সময়েও ইসলামী ব্যাংকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ৫২ শতাংশ শেয়ার ছিল। তবে পর্ষদে বসে এস আলম গ্রুপের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারি সিদ্ধান্তে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিলে দেশি ও বিদেশি শেয়ারধারীরা একে একে ব্যাংকটি ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে সব শেয়ার বিক্রি করে দেয় স্থানীয় উদ্যোক্তা ইবনে সিনা ট্রাস্ট। এরপর ওই বছরের মে মাসে কিছু শেয়ার বিক্রি করে দেয় আইডিবি। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির শেয়ার ছেড়ে দেয় কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস। গত বছরের জুনে শেয়ার ও পরিচালক পদ ছাড়ে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে শেয়ার ও পরিচালক পদ ছাড়ে সৌদি আরবের আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সি। এর কয়েক মাস পর গত বছরের অক্টোবরে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার ৬২৫টি শেয়ার বিক্রি করে দেয় আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থা ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। এমনকি চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে হাতে থাকা ৩৪ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয় ব্যাংকটির আরেক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার।
জানা যায়, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে বিদেশীদের হাতে থাকা ব্যাংকটির অর্ধেকের বেশি শেয়ারের পরিমাণ বর্তমানে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি ২০১৬ সালে ১৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা এস আলম গ্রুপ বর্তমানে ৮২ শতাংশ শেয়ারের মালিক। নামে বেনামে কেনা এসব শেয়ারের মাধ্যমে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য খাটিয়ে ইসলামী ব্যাংককে শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছে চট্টগ্রামভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই দীর্ঘ সময় ব্যাংকটি পরিচালনায় যুক্ত ছিল। তাতে গত ৩০ বছরে ব্যাংকটির দেশব্যাপী সুনাম, সুখ্যাতি ও আস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি ডিপোজিট, এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট, রেমিট্যান্সও বেড়েছে। এমনকি আইনকানুন পরিপালন, গ্রাহককে উত্তম সেবা দেওয়া ও আর্থিক সূচকে অন্য সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এই ব্যাংক। কিন্তু এস আলম গ্রুপের কর্তৃত্বে নিয়ম বহির্ভূত ঋণ বিতরণ, অর্থ পাচার, লুটের কারণে ব্যাংকটি তারল্য সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি দীর্ঘসময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলতে হয়েছে। দেশের শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংকে এমন লুটপাট চালাতে এস আলমকে সাহায্য করেছে তাদের নিয়োগকৃত কর্মকর্তারা।
সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে ইসলামী ব্যাংকে কর্মকর্তা ছিল ১৩ হাজার ৫৬৯ জন। ২০২৩ সালে তা বিশ হাজার ৮০৯ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক দখল করার বিগত বছরগুলো প্রায় ৯ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ। নির্দিষ্ট পলিসি, সার্কুলার, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ছাড়াই নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই সাইফুল আলমের নিজের এলাকা পটিয়া উপজেলার। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ব্যাংকে যুক্ত করানো এসব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এছাড়া বিভিন্ন উপায়ে ব্যাংক থেকে পাচার করা হয়েছে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা।
অবৈধ ঋণ বিতরণ, অর্থপাচার এবং অর্থ সংকটে ভোগা ইসলামী ব্যাংকের ওপর আস্থা হারিয়েছে আমানতকারীরা। গত এক বছরে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের আমানত তুলে নেওয়া হয়েছে। একইসাথে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ইসলামী ব্যাংকের সংঘর্ষের ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাতে সরকার পতনের শুরুর কয়েকদিন শেয়ার দর বাড়লেও আবার নিম্নমুখী হয়েছে ব্যাংকটির গতি।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট ৩২ দশমিক ৬০ পয়সা শেয়ার দরে লেনদেন শেষ করে ইসলামী ব্যাংক। তবে সরকার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শেয়ারবাজারের উত্থানের সময়ে ইসলামী ব্যাংকেরও শেয়ারদর বাড়তে থাকে। গত ১২ আগস্ট লেনদেন শেষে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর ছিল ৪৪ টাকা ৬০ পয়সা। তবে এরপর কমতে থাকে ব্যাংকটির শেয়ারদর। আজ শেয়ারের দাম ২ টাকা ১০ পয়সা কমায় ব্যাংকটি দরপতনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান নিয়েছে।