বাজারে অধিকাংশ সবজির দাম স্থিতিশীল থাকলেও বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। একই সাথে নিয়ন্ত্রণে আসছে না মাছের বাজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে একটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসার পর সিন্ডিকেট অন্য একটি পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আগে এসবিসিন্ডিকেট আগে ভাঙতে হবে বলে তারা মনে করছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। বিক্রেতারা বলছেন, সরবরাহ সঙ্কট ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মিরপুর-৬ কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী এমদাদ বলেন, গত সপ্তাহের মাঝামাঝি থেকে দাম বৃদ্ধি শুরু হয়েছে। ভারতে পেঁয়াজ বিক্রিতে কড়াকড়ি, আবার সেখানেও দাম বেড়েছে। বৃষ্টিতে পেঁয়াজ আসতেও সমস্যা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দাম বেড়েছে।
এদিকে শ্যামবাজারের আড়তদার জালাল উদ্দিন বলেন, শীতের আগে এই সময়টায় দেশি পেঁয়াজ ফুরিয়ে আসে। ফলে দাম বেড়ে যায়। অন্য দিকে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি চালু থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় তা পড়তায় পড়ছে না। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৭ টাকা। শীতের সবজি উঠলে দাম কমা শুরু হবে বলে দিনি জানান।
এদিকে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম নিয়মিত ওঠানামা করলেও মাছের বাজার দীর্ঘদিন ধরে বাড়তিই থেকে যাচ্ছে। ক্রেতাদের মতে, মাছের বাজারের অস্থিরতা কাটছে না কোনোভাবেই। অন্য দিকে বিক্রেতারা বলছেন, ফিডের দাম বৃদ্ধির পর থেকেই মাছের বাজার বাড়তি যাচ্ছে, যা আর কমেনি।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে সব ধরনের মাছের দাম বাড়তিই দেখা গেছে। পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা, লেয়ার মুরগি প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা, কক মুরগি প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগি আগের মতো বাড়তি দামে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। অন্য দিকে বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা আর খাসির মাংস ১১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
তবে বাজারে আগের মতোই বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে মাছ। বাজারে প্রতি কেজি চাষের কই ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, পাবদা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, রুই প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা, তেলাপিয়া প্রতি কেজি ২৫০ টাকা, প্রতি কেজি পাঙাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়, কাতল মাছ প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া, চিংড়ি প্রতি কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা, বোয়াল প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, সরপুঁটি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা, রুপচাঁদা প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা, শিং মাছ প্রতি কেজি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, গলসা প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, ট্যাংরা প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, চাপিলা মাছ প্রতি কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিরপুর-৬ বাজারে বেসরকারি চাকরিজীবী আসাদুর রহমান বলেন, বাজারের সব ধরনের পণ্যের দাম উঠানামা করলেও ব্যতিক্রম দেখি মাছের বাজারে। দীর্ঘদিন যাবত মাছের দাম কমার কোনো নাম নেই। সব সময় অতিরিক্ত দামে সব ধরনের মাছ কিনতে হচ্ছে। এক সময় পাঙাস, তেলাপিয়া, চাষের কই এসব মাছের দাম কম থাকলেও বর্তমান বাজারে এগুলোরও দাম বেশি।
রাজধানীর কাওরান বাজারের আরেক ক্রেতা আশরাফুল ইসলাম বলেন, এতদিন ধরে মাছের বাজার বাড়তি যাচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে মাছের বাজার মনিটরিং করার কোনো উদ্যোগ কখনো দেখি না। বিক্রেতারা নিজের ইচ্ছেমতো দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে মাছ বিক্রি করছে। বাজারে এমন কোনো মাছ নেই যার দাম বাড়তি না। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ ক্রেতারা তো আর মাছই কিনতে পারবে না।
কাওরান বাজারে মাছ বিক্রেতা আব্দুর রহিম বলেন, মূলত মাছের খাবারের দাম বৃদ্ধির পর থেকে বাজারে মাছের দাম বাড়তি। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আর মাছের দাম কমেনি। আমরা পাইকারি বাজারে গেলেও বাড়তি দামেই মাছ কিনে আনতে হয়, সেই প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারে।
তিনি বলেন, আমরা যখন থেকে তুলনামূলক কম দামে পাইকারি বাজার থেকে মাছ কিনে আনতে পারব, তখন আমরা তেমন কম দামেই খুচরা বাজারে মাছ বিক্রি করতে পারব। আমাদের কেনা যেমন দামে বিক্রিও তেমন দামে করতে হয়।
বাজারে গতকাল বেশির ভাগ সবজি ৮০ টাকার ওপরে থাকলেও চলতি সপ্তাহে কমেছে কয়েকটির দাম। প্রতি কেজি গোল বেগুন মানভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি করলা ১০০ টাকা, পটোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স ও ধুন্দল ৭০ থেকে ৮০ টাকা, শসা মানভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকা, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কচুরমুখি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, কচুর লতি ৮০ টাকা, টমেটো ১৬০ টাকা, গাজর ১৬০ টাকা, শিম ১২০ থেকে ১৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
লেবু ৩০ টাকা হালি, কলা ৪০ টাকা হালি, কাঁচামরিচ ২০০ টাকা ও আলু ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, প্রতি পিস লম্বা লাউ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সবজির বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের তেলেসমাতি : মধ্যস্বত্বভোগীদের তেলেসমাতিতেই এতদিন সবজির বাজার অস্থির ছিল বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, প্রতিদিন সবজির মূল আড়ৎ থেকে শুরু করে খুচরা বাজার পর্যন্ত খুচরা ধাপে ধাপে হাত বদলে কয়েক দফায় বাড়তি দামের পর খুচরা বিক্রেতাদের হাতে আসে। যার কারণে বাগানের দাম থেকে খুচরা বাজারে আসা পর্যন্ত প্রায় ৪০ শতাংশ দাম বেড়ে যায়। ফলে খুচরা বিক্রির জন্য বেশী দামে কিনে অল্প লাভে বিক্রি করেও ক্রেতাদের সাধ্যের বাইরে দাম চলে যাচ্ছে। আর এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
গতকাল বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহের চেয়ে এখন সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। বাজার অস্থিরতার বিষয়ে একাধিক পাইকারের সাথে কথা বলে তারা জানান, মূলত যেসব জেলা থেকে ঢাকায় সবজি আসে সেসব এলাকায় সবজির যে ক্ষেত হয় তা স্থানীয় পাইকাররা চুক্তিতে কিনে রাখেন। এরপর সে সবজি বাগান থেকে স্থানীয় পাইকারদের কাছে আরেক দফা বিক্রি হয়। সেখানে থেকে আসে ঢাকায়। কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আসার পর তা গাড়ি থেকে নামানোর আগেই চুক্তিতে রাজধানীর পাইকাররা কিনে নেয়। তাদের কাছ থেকেই খুচরা বিক্রেতারা কিনে আনার পর সাধারণ মানুষের হাতে আসে। ক্রয়-বিক্রয়ের এই কয়েক ধাপে তরকারীর দাম বাগানের দামের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। ফলে গত কয়েক দিন মাঠে কৃষক যে লাউ পাইকারের কাছে সর্বোচ্চ ৮০ টাকায় বিক্রি করেছেন সে লাউ খুচরা বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা ১২০ টাকার মিষ্টিকুমড়া পিস বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকায়। এভাবে করে প্রতি তরকারিতে প্রায় ৪০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে।
অন্য দিকে কিছু পাইকার জানান, অসময়ে বন্যায় তরকারির বাগান নষ্ট হয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য না থাকায় বিগত কিছু দিন বাজার অস্থির থাকলেও এখন দাম কমছে। তবে সবজি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তা দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে জানিয়ে তারা বলেন, সার ও বীজের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে উঠতে শুরু করেছে শীতকালীন নতুন শাক-সবজি। কয়েটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজির দাম কমেছে ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত। বক্রেতারা জানান, এখন প্রতিদিন সরবরাহ বাড়ছে। গতকাল মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হয়েছে ৮০-১২০ টাকা, করলা ৬০-৭০ টাকা, ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, মূলা ৫০-৬০ টাকা, লতি ৮০ টাকা, কহি ৬০ টাকা, ধুন্দল ৫০ টাকা ও পটোল ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি পেঁপে ২০-৩০ টাকা, কাঁকরোল ৮০ টাকা, গাজর ১০০ টাকা, কচুরমুখী ৮০ টাকা, টমেটো ১৮০ টাকা, শিম ১৪০-১৬০ টাকা ও শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। চিচিঙ্গা বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকায়। আর মানভেদে প্রতি পিস ফুলকপি ৪০-৬০ টাকা, বাঁধাকপি ৬০ টাকা এবং লাউয়ের জন্য গুনতে হচ্ছে ৫০-৭০ টাকা।