জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেছেন, অতি দ্রুত গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি চুন্নুকে অপসারণ করতে হবে, ২০২২ সালের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন বাতিল করতে হবে। ওই আইনের অধীনে গঠিত নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে পাওয়া প্রস্তাবের আলোকে নতুন আইনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
রোববার (২৪ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ব্যতিরেকেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রতিবাদে এ জরুরি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সামান্তা শারমিন বলেন, গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে জনগণকে জিম্মি করেছিল, তার মধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি। ফ্যাসিবাদ কায়েমের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠন করে এবং বেছে বেছে সুকৌশলে নিজেদের লোক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে জিম্মি করে নামকাওয়াস্তে ডামি নির্বাচন দেয়। তারা জনগণের প্রায় সবরকম মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। ব্যালট বক্স ডাকাতি, বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হত্যা, গুম, অপহরণ এবং ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতা দখল করে। এই পুরো প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ২০২২ সালে প্রণীত নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আইন। এ আইনসহ অন্য নিবর্তনমূলক আইনের ওপর দাঁড়িয়ে বিগত গণহত্যাকারী সরকার আয়নাঘর, হত্যা ও গুমের মতো নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। সেই কালাকানুনের অধীনে ইসি গঠন করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কলঙ্কিত করেছে।
লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছে। এ কাজ গণঅভ্যুত্থানের কমিটমেন্টের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের সর্বস্তরের ছাত্র ও জনগণ গণঅভ্যুত্থানের শরিক। কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে ড. মুহম্মদ ইউনূস এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস ও অন্য উপদেষ্টাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। ড. ইউনূস দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেবেন– এটাই শিক্ষার্থী, তরুণ সমাজ ও অভ্যুত্থানের শরিকরা প্রত্যাশা করেন। আমাদের প্রত্যাশা, তিনি শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজের বার্তা বুঝতে পারেন এবং তাদের আহ্বানে সাড়া দেবেন।
তিন মাসের অধিক সময় ক্ষমতায় থেকে এ সরকার ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজের ক্ষেত্র ও সীমা অতিক্রম করেছে জানিয়ে সামান্তা শারমিন বলেন, এ সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত। কাজেই সরকারকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি ধারণ করতে হবে। সরকার হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে নির্বাচন নিয়ে তড়িঘড়ি করা যাবে না। এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্পন্ন না করে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিলে এ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ তিন মাসের অধিক সময়ে নিষ্পন্ন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে, যা সরকারের বৈধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
‘ড. ইউনূসকে মনে রাখতে হবে, তিনি ছাত্র-জনতার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। তরুণ শিক্ষার্থী সমাজসহ আপামর জনগণের কাছেই তিনি দায়বদ্ধ। রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে সংস্কার হবে না, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য আমরা তার কাছ থেকে শুনতে চাই না।’
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মূলোৎপাটন করতে শিক্ষার্থী ও সর্বস্তরের মানুষ জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র। তিনি বলেন, দুই হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন, ছয় শতাধিক যোদ্ধা চোখ হারিয়েছেন, হাজারের বেশি যোদ্ধা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। শিক্ষার্থী, তরুণ সমাজ ও জনগণ জীবন দিয়ে যে সরকারকে বসিয়েছে, সেই সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করবে বলেই আমরা আশা করি। জনগণ গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না।
সামান্তা শারমিন বলেন, এখনো সরকারের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এ সরকার জনগণের অভিপ্রায়কে প্রতিনিধিত্ব করবে তথা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়াই তড়িঘড়ি করে নির্বাচন আয়োজন করার দিকে অগ্রসর হবে না– এটাই আমাদের দাবি। ড. ইউনূস ও তার সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদী ও অবৈধ সংবিধানের আইনি কাঠামোয় নির্বাচন দিতে এত শহীদ প্রাণ দেননি। তাছাড়া গণঅভ্যুত্থানের দাবি কেবল নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপের লক্ষ্যে সব ধরনের সংস্কার-পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জিত হবে না এবং তা শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানির শামিল।
এসময় জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সদস্য আকরাম হোসেন, মশিউর রহমান ও আবু রায়হান খান প্রমুখ।