জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর শেরে বাংলা রোডস্থ খুলনা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয় ‘শহীদ পরিবারের পাশে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ কর্মসূচির। এসময় খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মোট ৫৮ শহীদ পরিবারের মধ্যে পাঁচ লাখ করে সর্বমোট দু’কোটি ৯০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়।
এসময় উপস্থিত ছিলেন শহীদ রাকিবুল হাসানের মা মোসা. হাফিজা খাতুন। তিনি একজন ক্যান্সারের রোগী।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেওয়া আর্থিক সহযোগিতা নিতে ঝিনাইদহ থেকে এসেছিলেন খুলনায়। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বলেন, ‘সন্তানহারা মা কখনও সন্তানকে ভুলতে পারে না, আমি একজন ক্যান্সার পেশেন্ট, আমি কিভাবে চলি আমার সন্তান ছাড়া?’ ১৯ জুলাই ঢাকার মীরপুরে শহীদ হওয়া রাকিবুল হাসানের সঙ্গে এ মায়ের শেষ কথা হয়েছিল আগের রাত আটটা ৩৫ মিনিটে।
সাংবাদিকদের মাধ্যমে এই শহীদী মায়ের দেশবাসীর কাছে একটাই চাওয়া ‘দেশবাসী যেন জুলাই-আগষ্ট শহীদদের ভুলে না যায়’।
ছাত্র-জনতা যে নতুন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল তেমন বাংলাদেশই চান তিনি। তার সন্তান রাকিবুল হাসান ছাড়াও মুগ্ধ, আবু সাইদসহ গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণ করেন তিনি।
প্রারম্ভিক বক্তৃতায় ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘খুলনা বিভাগে মোট ৮৪জন শহীদ হয়েছেন জুলাই-আগষ্ট আন্দোলনে। প্রথমপর্বে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫৮ জনকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হলেও বাকীদের পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।
জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া কর্মসূচির শুরুতেই জুলাই-আগষ্টের শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপর দেখানো হয় আট মিনিট ২৫ সেকেন্ডের একটি ডকুমেন্টরী ‘জলাই অনির্বাণ’। যেখানে ফুটে ওঠে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র। যা দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
কেউ নিরবে আবার কেউ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন।
যেন পিন পতন নিরবতা চলে পুরো সময় জুড়ে। সন্তানহারা পিতা-মাতা-বোনের স্মৃতি যেন সামনে নিয়ে আসে আবু সাইদ-মুগ্ধদের। আবার জীবন্ত শহীদদের অনেকের পঙ্গু জীবনের চিত্রও কাঁদায় উপস্থিত অনেককে। আনাসের লেখা চিঠি পড়তে গিয়ে তার মায়ের মতো কাঁদেন অনেকেই। পিতাহারা অবুঝ সন্তানের পরিচয়পত্র এখনও তাকে মনে করিয়ে দেয় ‘এইতো বাবা আসছে’।
‘শহীদ পরিবারের পাশে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ কর্মসূচিতে বক্তৃতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আশ শেফা খাতুন বললেন, ‘আমাদের কষ্টের সাথে শহীদ পরিবারের কষ্টের তুলনা হবে না। কেননা আমাদের কষ্ট সাময়িক সময়ের জন্য, কিন্তু শহীদ পরিবারের কান্না থাকবে সারাজীবন।’ সুতরাং কেউ যাতে শহীদ পরিবারের সঙ্গে বেঈমানী না করতে পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখার আহবান তার।
এসময় অপর সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন আহত ও শহীদ পরিবারের ঠিকানা। চার মাস অতিবাহিত হলেও গণঅভ্যুত্থানে নিহত একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। কাজের মাধ্যমেই পুলিশ ও বিচার বিভাগের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে পুলিশকে যেভাবে দলীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এতে শুধু পুলিশেরই ইমেজ নষ্ট হয়নি বরং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হয়েছে।’
পুলিশের ইমেজ নষ্ট হওয়ার কথা অকপটে স্বীকারও করেন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার। তিনি বলেন, ‘বিগত ১৬ বছরে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয় কাজে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতীয় ১০ লাখ লোক এদেশে কিভাবে ছিল সেটিও তদন্তের দাবি রাখে।’
তিনি বলেন, ‘বিগত দিনের গ্লানি মুছে আমরা জনগণের পুলিশে পরিণত হতে চাই। জুলাই-আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতিগুলোই আমাদের সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। কারণ এটিই এক সময় ইতিহাস হয়ে থাকবে।’
খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার তার বক্তব্যে বলেন, তিনি নিজেও জুলাই-আগষ্টের আন্দোলনের ফল ভোগ করছেন। কেননা বিগত ১৫ বছরে তিনি ছিলেন পদোন্নতি বঞ্চিত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলেই তিনি আজ বিভাগীয় কমিশনার। সুতরাং যাদের আন্দোলনের ফলে তারা আজ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন তাদের শপথ ভঙ্গ করা চলবে না।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার মধ্য দিয়ে তিনি এক নতুন বাংলাদেশ গড়তে চান বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সকলকে সজাগ থাকারও আহবান জানান তিনি।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তারিকুল ইসলাম, খুলনার পুলিশ সুপার টিএম মোশাররফ হোসেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় নেতা মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান, খুলনার জেলা প্রশাসক মোহামমদ সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।