৪৩তম বিসিএস বৈষম্যের অবসান চান নন-ক্যাডার প্রার্থীরা

৪৩তম বিসিএসের বৈষম্যমূলক নন-ক্যাডার ফলাফল বাতিল করে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার বঞ্চিত এমন প্রার্থীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন প্রার্থীরা। এছাড়া ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত শূন্যপদ গুলোতে নন ক্যাডার প্রার্থীদের সুপারিশ এবং ২০১৪ এর নন-ক্যাডার বিধি অনুযায়ী পরবর্তী চলমান বিসিএসগুলোতে নন-ক্যাডার নিয়োগের দাবি রয়েছে প্রার্থীদের।

৪৩তম বিসিএসে আবেদন করেছিলেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন প্রার্থী। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তিন বছর পর এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। তবে এই বিসিএসে প্রথমবারের মত ক্যাডার পদের সঙ্গেই নন-ক্যাডার পদেরও ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ফলে এতে অধিকাংশ প্রার্থীকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।

প্রার্থীদের অভিযোগ, আগের বিসিএসগুলোতে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী নন-ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ ৩৪তম-২২৫৭, ৩৫তম-২০৩৬, ৩৬তম-১২৮৭, ৩৭তম-১৭৪৩, ৩৮তম-২৭৫১ জন, ৪০তম-৩৬৫৭ এবং ৪১তম-৩১৬৪ জনকে সুপারিশ করা হয়। অথচ ৪৩তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে মাত্র ১ হাজার ৩৪২ পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও ফল প্রকাশ করে মাত্র ৬৪২ জনকে সুপারিশ করা হয়। বাকি পদগুলো বিশেষায়িত হওয়ায় সেগুলো যোগ্যপ্রার্থী না থাকায় শূন্য থাকে। এছাড়া সাধারণ প্রার্থীদের ৫৪টি পদও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে সাধারণ প্রার্থীদের জন্য নবম ও দশম গ্রেডের পদ বাকি ছিল মাত্র ৭৫টি। এতে অধিকাংশ প্রার্থীই চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। তারা বলছেন, ১ হাজার ৩৪২ পদের মধ্যে ৮৮৮ পদই ৪১তম থেকে ফেরত আসা। সেই হিসাবে নতুন পদ এসেছে মাত্র ৪৫৪টি। অথচ ৪৩তম নন-ক্যাডার প্রার্থীদের সুপারিশের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অধিযাচনের প্রেক্ষিতে ২৯২১টি পদের তালিকা পাঠানো হয়। কিন্তু অদৃশ্য কোনো এক কারণে এসব পদের অধিকাংশই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। যা প্রার্থীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ ও প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।

প্রার্থীরা জানান, ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় বলা হয়নি যে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের ফল একসঙ্গে প্রকাশ করা হবে; বরং ৩২ অনুচ্ছেদে আগের বিসিএসের মতোই নন-ক্যাডারে নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের আগে হঠাৎ করে ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নন-ক্যাডারের ১ হাজার ৩৪২ পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে এই বিজ্ঞপ্তিকে প্রহসনমূলক আখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান, পিএসসির সামনে মানববন্ধন, কাফনের কাপড় পরিধান থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন প্রার্থীরা। এতেও পিএসসি কর্ণপাত না করে বিধিলঙ্ঘন করে একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের ফলাফল একসাথে প্রকাশ করে, যা নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা-২০১০, সংশোধিত বিধিমালা-২০১৪ এর পরিপন্থী। ফলে সংক্ষুদ্ধ প্রার্থীরা আদালতের দ্বারস্থ হন।

তারা প্রথমে বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সহ ০৩ জনকে আইনি নোটিশ এবং পরে একটি রিট মামলা দায়ের করেন। মামলাটির শুনানি শেষে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনে মহামান্য হাইকোর্ট বিপিএসসিকে ৪৩তম বিসিএস ভাইভায় চুড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ কিন্তু পদস্বল্পতার কারণে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হননি এমন প্রার্থীর পূর্ণাঙ্গ নন-ক্যাডার তালিকা প্রকাশ এবং নন-ক্যাডার ফলাফল কেন বাতিল করা হবে না ও ভাইভায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদেরকে কেনো ৪৪ তম বিসিএসের চুড়ান্ত ফলাফল এর পূর্ব পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। কিন্তু বিপিএসসি মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন এবং বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে কোনো জবাব দেয়নি। ফলে পিটিশনারদের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব অনতিবিলম্বে হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন ও রুলের জবাব না দেওয়ায় বিপিএসসির চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করার কথা জানিয়ে পুনরায় একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এর প্রেক্ষিতে বিপিএসসি রিট মামলায় হাইকোর্টের অর্ডার বাস্তবায়ন না করে ও বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে রুলের জবাব না দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের চেম্বার আদালত থেকে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। এতে দীর্ঘদিন ধরে প্রিলি-লিখিত ও ভাইভায় উত্তীর্ণ হয়ে আসা মেধাবী প্রার্থীরা অধিকার বঞ্চিত হয়ে চরম হতাশায় ভুগছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিসিএস উত্তীর্ণদের থেকে ৯ম-১২তম গ্রেডে নিয়োগের জন্য নন-ক্যাডার নিয়োগের পূর্বেও উদ্যোগটি ভালো ছিল। বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি বিসিএসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর প্রার্থীদের কাছ থেকে নন-ক্যাডারে আবেদন নেয়া হতো। পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেই অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া হতো। এভাবেই নন-ক্যাডারে বিপুলসংখ্যক মেধাবী ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছেন। তবে ২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়, যা নন-ক্যাডার বান্ধব নয়। পাশাপাশি ২০২০ সালে প্রকাশিত ৪৩তম বিসিএসের ক্ষেত্রে এই বিধি প্রযোজ্য নয়। পিএসসি নিজেও ৪৬তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার সময় নতুন বিধি মানেনি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগের ফলে অনিয়ম-দুর্নীতি অনেকটা বন্ধ হয়েছে। তাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ৯ম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত পদগুলোতে বিসিএস থেকে নিয়োগ দেয়া হলে নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি মেধাবীদের যোগ্য স্থানে পদায়নের সুযোগ তৈরি হবে। এতে বৈষম্য ও দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। তাই আইন বা বিধিমালা তৈরি করে বেশি প্রার্থীর চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা উচিত নয়; বরং বেশি নিয়োগ দেয়ার জন্য পিএসসির আরো আন্তরিক হওয়া উচিত বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। এর প্রেক্ষিতে ৪৩তম বিসিএসে নন-কাডারের যোগ্যপ্রার্থীরা নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বৈষমের অবসান ঘটিয়ে শূন্যপদে নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন।