দাম বাড়ার প্রভাব স্বর্ণের ব্যবসায়

অনেকে বদলেছেন পেশা

মাসুমা আক্তার: সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রাচুর্য প্রদর্শন ও অর্থনৈতিক শক্তির ভিত হিসেবে গুরুত্ব বহন করছে স্বর্ণ। আর স্বর্ণের তৈরি গহনার চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যতা অভিভূত করে সবাইকে। তবে দেশে একাধিকবার স্বর্ণের দাম ওঠানামা করায় রাজশাহীর স্বর্ণালংকার ব্যবসা খাতে দেখা দিয়েছে মন্দা। দামের প্রভাবে কমেছে চাহিদা। মালিকানা বদলের পাশাপাশি কেউ-কেউ বদলাচ্ছেন পেশাও।

নগরীর সাহেব বাজার সোনাপট্টির এন হুদা জুয়েলার্স ভারত ভাগের পর প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। বহু চড়াই উতরাই পেড়িয়ে নাদিব মিয়া টিকিয়ে রেখেছেন পৈত্রিক এ স্বর্ণালংকার ব্যবসাটি। তবে কয়েক বছরে একাধিকবার স্বর্ণের দর ওঠানামায় কমেছে গহনার বিকি-কিনি।

নাদিব মিয়া বলেন, ‘স্বর্ণের দাম এক দাম থাকলে আমাদের বেচাকেনা ভালো থাকতো। তাহলে, ক্রেতারা ঘুরে যেতো না। দাম ওঠা নামা করায় একেক সময় একেক দাম থাকে। ক্রেতারা তখন বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের সমস্যাটা আরও বেশি হচ্ছে।’

শুধু এন হুদা জুয়েলার্সই নয়, সোনাপট্টির ছোট-বড় প্রায় দেড় শতাধিক স্বর্ণের প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ব্যবসায়িক চিত্র একই। পাঁচ বছরে এসব দোকানে প্রায় অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে গহনার বিক্রি। এ অবস্থায় দোকান ভাড়া, কারিগর ও কর্মচারীদের মজুরিসহ প্রতিষ্ঠানের আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেই সাথে চলমান মন্দায় ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার শঙ্কাও করছেন অনেকে।

স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী বলেন, ‘১ লাখ ২০ হাজার টাকা ২২ ক্যারেট, র ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ২১ ক্যারেট। নিম্নবিত্ত কারও ক্ষমতা নেই বানানোর। দোকানে আগে ৬ টা কারিগর ছিল, এখন সেখানে দুইজন কারিগর আছে।’

বাজুসের তথ্যমতে, ২০ বছর আগে দেশে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ৬ হাজার টাকা। বর্তমানে যা বেড়ে প্রতি ভরি ঠেকেছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। তাতে গেলো দুই দশকে বিশ গুণ দাম বেড়েছে এই মূল্যবান ধাতুর। আর চলতি বছরেই দাম বেড়েছে ১৬ বার। ক্রমাগত এই মূল্যবৃদ্ধিতে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের। আর দরের অস্বাভাবিক ওঠা-নামায় ক্রেতারা বিভ্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি নানা জটিলতায় পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।

একজন ক্রেতা বলেন, ‘কোনো গহনাই বানানোর সাহস করতে পারছি না। মেয়েদের শখ থাকে গহনা নেয়া। কিন্তু দাম এতো বেশি বেড়েছে যে সেই শখ পূরণ করা সম্ভব হয় না।’

ক্রেতা-ব্যবসায়ী ছাড়াও এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে গহনা তৈরির কারিগরদের ওপরে। দামের প্রভাবে ভারি গহনার চাহিদা কমায় কমেছে কাজ। একসময় মাস জুড়ে কাজ থাকলেও বর্তমানে কাজ করছেন মাত্র এক সপ্তাহ। তাতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আয় কমে ঠেকেছে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায়। তাই বাধ্য হয়ে পেশা বদলেছেন অনেকেই।

একজন গহনা কারিগর বলেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের কাজ অনেক বেশি কমে গেছে। সংসার চালাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। আগে দিনে এক হাজার টাকা ইনকাম করতাম। কিন্তু, এখন ৫০০ টাকাও হয় না।’

স্বর্ণের ব্যবসা করতে প্রয়োজন হয় মোটা অঙ্কের পুঁজি। তাই ব্যবসায়িক মন্দা কাটাতে ব্যাংকঋণসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারণে বাজুসের সহযোগিতা চান সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির রাজশাহী শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সুকুমার প্রামাণিক বলেন, ‘অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংক থেকে লোন দেয়। কিন্তু আমাদের দেয় না। স্বর্ণের ব্যবসায় পুঁজি লাগে অনেক।, আমরা তো সেই পুঁজিটাই পাই না।’

শহরজুড়ে রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক জুয়েলারি দোকান। প্রতিমাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকার গহনার বিকিকিনি হয় এসব দোকানে। তবে নানা সংকটের মুখে দিনে দিনে জৌলুস হারাতে বসেছে মূল্যবান ধাতুর এ ব্যবসা।