মোঃ সুমন হাওলাদার: চাহিদা জোগান এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির অপকৌশলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বাজার। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র মাঝারি জনগোষ্ঠী ও প্রান্তিক খামারিরা
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রান্তিক খামারিরা মুরগির বাচ্চা, ফিড, ওষুধসহ উৎপাদন খরচ বহন করে বিপুল পরিশ্রমে ডিম ও মুরগি উৎপাদন করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি, কর্পোরেট কোম্পানি ও একাধিক সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছেমতো ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করছে, যার ফলে খামারিরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের ডিম ও মুরগির বাজার একটি সুপরিকল্পিত সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপনার নামে “দিনের বাজার” ও “রাতের বাজার” কৌশল প্রয়োগ করে খামারিদের ঠকানো হচ্ছে এবং ভোক্তাদের কাছ থেকেও অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা হচ্ছে। সরকার দাম নির্ধারণ করলেও বাজারে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না, কারণ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
🔹 প্রান্তিক খামারিরা সর্বদা অবহেলিত – কেন?
✔ মুরগির বাচ্চার দাম খামারিরা ৮০-১০০ টাকায় কিনেছে, কিন্তু সেই মুরগি বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১৫০ টাকায়।
✔ ব্রয়লার, সোনালি ও কালার বার্ড মুরগিতে প্রতি কেজিতে ৩০-৫০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের।
✔ একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.২৯-১০.৫০ টাকা হলেও খামারিদের তা বিক্রি করতে হচ্ছে ৬-৮ টাকায়, ফলে প্রতি ডিমে ২-৩ টাকা লোকসান হচ্ছে।
✔ খামারিরা উৎপাদন করলেও বাজারে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নেই, যা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের হাতে।
🔹 মুরগির বাচ্চা সিন্ডিকেট: কর্পোরেট কোম্পানির ফাঁদ
✔ দেশের কিছু বড় কর্পোরেট কোম্পানি মুরগির বাচ্চার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
✔ চাহিদা বেশি থাকলে বাচ্চার দাম ৮০-১০০ টাকায় বাড়িয়ে দেয়, ফলে খামারিরা বেশি খরচ করে মুরগির উৎপাদন শুরু করে।
✔ কয়েক মাস পর পরিকল্পিতভাবে বাজারে অতিরিক্ত বাচ্চা সরবরাহ করে দাম ১০-২০ টাকায় নামিয়ে আনে, এতে নতুন খামারিরা উৎসাহিত হয়।
✔ খামারিরা উচ্চ দামে বাচ্চা কিনে যখন মুরগি উৎপাদন শেষ করে, তখন সিন্ডিকেট মুরগির দাম কমিয়ে দেয়, ফলে প্রান্তিক খামারিরা বড় ধরনের লোকসানে পড়ে।
✔ কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিজেদের মুরগির খামারের জন্য দাম স্থিতিশীল রাখে, কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের ক্ষেত্রে তারা বাজার কৌশল প্রয়োগ করে।
🔹 সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য: কারা নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার?
✔ তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও পাইকারি সিন্ডিকেট নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
✔ রাতের বেলায় সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থে ডিমের দাম ঠিক করে, সকালে খামারিরা ক্ষতির মুখে পড়ে।
✔ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে ভোক্তা ও খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
✔ দাম কমানোর সময় পরিকল্পিতভাবে খামারিদের বাধ্য করা হয় লোকসানে বিক্রি করতে।
🔹 “দিনের বাজার” ও “রাতের বাজার”: সিন্ডিকেটের কারসাজি
✔ “রাতের বাজার” – সিন্ডিকেট কম দামে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনে মজুদ করে।
✔ “দিনের বাজার” – পরিকল্পিত সংকট তৈরি করে সিন্ডিকেট নিজেদের ইচ্ছেমতো বেশি দামে বিক্রি করে।
✔ সিন্ডিকেটের এই কৌশলের ফলে খামারিরা ন্যায্যমূল্য পায় না, আর সাধারণ ভোক্তারা উচ্চমূল্যে ডিম কিনতে বাধ্য হয়।
✔ খামারিদের উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাজার সিন্ডিকেটের কারণে তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে।
🔹 সরকারের নির্ধারিত দাম বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?
✔ সরকার যখন ডিমের দাম নির্ধারণ করে, তখন সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে।
✔ বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বা বেশি দেখিয়ে ইচ্ছেমতো দর নির্ধারণ করা হয়।
✔ সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যর্থ হচ্ছে, কারণ সিন্ডিকেট সব সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
✔ সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত দাম কখনোই বাজারে কার্যকর হয় না।
🔹 বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের দাবি
✔তেজগাঁও ডিম সমিতির ডিমের দাম নির্ধারণ দিনের বাজার ও “রাতের বাজার” নামে ডিমের দাম নির্ধারণ সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে এবং স্বচ্ছ দর নির্ধারণ করতে হবে।
✔ সরকারকে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
✔ প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কেনার ব্যবস্থা করতে হবে।
✔ তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির স্বেচ্ছাচারী দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বাতিল করতে হবে।
✔ পোল্ট্রি ফিড, মুরগির বাচ্চা ও ডিম-মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা গঠন করতে হবে।
✔ প্রান্তিক খামারিদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ চালু করতে হবে, যাতে তারা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে।
🔹 সিন্ডিকেট বন্ধ না হলে কী হবে?
✔ লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক খামারি দেউলিয়া হয়ে যাবে, দেশের পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস হবে।
✔ ডিম-মুরগির বাজার পুরোপুরি অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাবে।
✔ সাধারণ ভোক্তারা অত্যধিক মূল্যে ডিম-মুরগি কিনতে বাধ্য হবে।
✔ সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যর্থ হবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের দাম আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে – সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রান্তিক খামারিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে!
প্রান্তিক খামারিদের রক্ষা করা গেলে, দেশের পোল্ট্রি শিল্প বাঁচবে এবং সাধারণ মানুষও ন্যায্য দামে ডিম কিনতে পারবে।
সভাপতি বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন হোয়াটসঅ্যাপ