বুকজ্বলা, পেটব্যথা, অতিরিক্ত ঢেকুর, পেটফাঁপা—এই উপসর্গগুলো আমাদের অনেকেরই পরিচিত। আমরা সাধারণত এই সমস্যাগুলোকে ‘গ্যাস্ট্রিক’ বলে থাকি এবং এর সমাধানে চটজলদি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করি। এমনকি দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন এমন অনেক ব্যক্তিও যেকোনো ওষুধের সাথে গ্যাসের ওষুধ খাওয়াকে আবশ্যক মনে করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা বলছে, মাসের পর মাস বা টানা গ্যাসের ওষুধ সেবন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার মূল কারণগুলো প্রায়শই আমাদের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত। সময়মতো খাবার না খাওয়া, বাইরের খাবার বা অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত ভোজন, ধূমপান, মদ্যপান এবং অপর্যাপ্ত ঘুম—এই অভ্যাসগুলো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস্ট্রিকের উপসর্গ দেখা দিলেই ওষুধের দিকে ঝুঁকে না পড়ে আগে জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনা জরুরি। খাবারের সময়সূচি ঠিক করা, স্বাস্থ্যকর এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়া, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা—এই অভ্যাসগুলো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক হতে পারে।
দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ সেবনের সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো হলো:
হাড়ক্ষয় রোগ: ক্যালসিয়াম শোষণ কমে যাওয়ায় হাড়ের ঘনত্ব কমে এবং হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে।
রক্তশূন্যতা: আয়রন শোষণ ব্যাহত হওয়ায় আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা হতে পারে।
পাকস্থলীর ক্যানসারের আশঙ্কা বৃদ্ধি: গ্যাস্ট্রিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যাওয়ায় পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি: ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
কিডনি রোগ: কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
অম্লত্ব বৃদ্ধি (রিবাউন্ড হাইপারঅ্যাসিডিটি): হরমোনের প্রভাবে অ্যাসিড তৈরি হওয়া অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে, যা ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়।
ভিটামিনসহ বিভিন্ন খনিজ লবণের ঘাটতি: ভিটামিন বি১২, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের শোষণ কমে যায়।
গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি হলো জীবনযাত্রার সঠিক পরিবর্তন:
খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ঝাল, তেল, মসলাযুক্ত এবং চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। দুধ এবং দুধের তৈরি খাবার, শাক পাতা, রেড মিটও অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়াতে পারে, তাই এগুলো পরিমিত পরিমাণে বা প্রয়োজন অনুযায়ী বর্জন করতে হবে। ফাস্ট ফুড, দুধ চা, কফি, ধূমপান, অ্যালকোহল ও কোমল পানীয় পান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
খাওয়ার নিয়ম: একবারে বেশি পরিমাণে খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খাবার গ্রহণ করা উচিত। এতে পাকস্থলীর ওপর চাপ কম পড়ে।
নিয়মিত শরীরচর্চা: নিয়মিত হাঁটাচলা এবং হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এটি হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।
পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং হজম প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
গ্যাস্ট্রো-ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) যাদের আছে, তাদের জন্য কিছু বিশেষ সতর্কতা:
ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন GERD এর উপসর্গ বাড়াতে পারে, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শোবার নিয়ম: ঘুমানোর সময় মাথার দিকের অংশ কিছুটা উঁচু করে রাখলে অ্যাসিড রিফ্লাক্সের ঝুঁকি কমে।
পোশাক: আঁটসাট পোশাক পরা থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এটি পেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
খাবার ও পানি: খাবারের মাঝখানে পানি পান না করে খাবার খাওয়ার আগে বা পরে পানি পান করা উচিত।
রাতের খাবার: রাতে ঘুমানোর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার শেষ করা উচিত, যাতে খাবার হজম হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে জীবনযাত্রার পরিবর্তন করেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। যদি সমস্যা গুরুতর হয় বা ঘরোয়া উপায়ে সমাধান না হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্বল্প সময়ের জন্য গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্যাসের ওষুধ সেবন করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধে সচেতন হোন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন।