আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু, উচ্চঝুঁকিতে ঢাকাসহ ১৮ জেলা 

দেশব্যাপী ফের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। একদিকে যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের হার, তেমনি প্রতিদিনই স্বজনহারা হচ্ছেন কেউ না কেউ। সবশেষ ২৪ ঘণ্টায়ও মশাবাহিত রোগটি দুজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৮৬৬ জন। সব মিলিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৩৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। আক্রান্তের সংখ্যাও এরই মধ্যে ২৫ হাজার ছুঁই ছুঁই। এই যখন পরিস্থিতি, তখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি শিগগিরই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আসছে অক্টোবরে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলা উচ্চঝুঁকিতে আছে বলে জানাচ্ছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত আগস্টে পুরো মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী, যেখানে প্রাণহানি ঘটেছে ২৭ জনের। চলতি মাসের ২৩ দিনেই প্রায় দ্বিগুণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে। এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৩২ ডেঙ্গু আক্রান্তের হিসাব পাওয়া গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে। এই ২৩ দিনে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ জন। যাদের ২৫ জনই মারা গেছেন শেষ ৭ দিনে। এ ছাড়া গত ১০ দিনে মৃত্যুহীন দিন যায়নি একটিও।

এবার মৌসুম শুরুর পর থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে মশকনিধনে প্রস্তুতির অভাব। বলা হচ্ছে, গণ-আন্দোলনের সময় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে হামলার ঘটনায় একদিকে যেমন অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে, তেমনি পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখনও যথাযথভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেনি প্রশাসন। স্বল্প সময়ে যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে প্রাণ কেড়ে নেওয়াতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলে ডেঙ্গু। ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই বছর। তার আগের বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলে ৮৬৮। আর চলতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু পর থেকেই ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। যদিও পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অতটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েনি, তবুও দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে ডেঙ্গুর প্রকোপে লাগাম টানা মুশকিলই হবে বলে ধারণা করছেন স্বাস্থ্য চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এ এলাকায়।

মশকনিধন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে। তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলে ১০টি দল গঠন করা হয়েছে।

অপরদিকে, দক্ষিণ সিটি (ডিএসসিসি) থেকে মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যারা বিভিন্ন এলাকায় মশা মারার কাজ করছেন, তাদের শরীরে ডিভাইস যুক্ত করা আছে। এর মাধ্যমে কর্মীদের গতিবিধি লক্ষ করা যাচ্ছে।

দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, জুলাই-আগস্ট মাসের সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা চুরি হয়েছে। উত্তর সিটিতে ১৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। তারপরও নগর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাজ চলছে।

যোগাযোগ করা হলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম জানান, ডেঙ্গু বিষয়ে আগে যেসব পরিকল্পনা করা ছিল, সেই অনুযায়ীই কাজ করছেন তারা। কাউন্সিলর না থাকার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন তিনি।

অন্যদিকে ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মহা. শের আলী বলছেন, দক্ষিণ সিটির আওতায় হাসপাতালে যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, এগুলো এই করপোরেশনের বলা হচ্ছে। তবে হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব রোগীদের অনেকে ঢাকারে বাইরে থেকে এসেছেন।

তবে, রাজধানীর রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, তেজগাঁও, বাড্ডা, ফার্মগেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই মাসে মশকনিধন কার্যক্রম খুব একটা দেখেননি তারা। এদিকে গত ১০-১৫ দিনে মশার উৎপাত অনেক বেড়েছে এসব এলাকায়।

অবশ্য, বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিতে পারে-এমন আগাম সতর্কবার্তা আগেই দিয়ে রেখেছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। রাজধানী ছাড়াও বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, মেহেরপুর, ঢাকার পাশের ময়মনসিংহ, মাদারীপুর ও মানিকগঞ্জে পরিস্থিতি খারাপ হবে। বিশেষ করে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে সৃষ্ট ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ চোখ রাঙাচ্ছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের দিকে।