অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাট বাড়ানো ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত : মুস্তফা কে মুজেরি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভুল সময়ে ভুল নীতি নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মনে হয়, এ সময়ে অর্থনীতিতে সফলতা নেই বললেই চলে।

আমাদের মৌলিক সমস্যা যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি অথবা প্রবৃদ্ধির ধীরগতির কারণে অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। অন্যান্য যেসব সমস্যা আছে সেখানেও খুব একটা সফলতা নেই। ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমান সরকারের নেয়া অর্থনৈতিক নীতিগুলোর একটা সাধারণ ধরন রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া। জানি না, সেটি কেন হচ্ছে। তার একটা বড় উদাহরণ, অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাটের হার বাড়ানো। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল সময়ে নেয়া হয়েছে। তার পরিণতি আগামী দিনগুলোতে ভালো হবেÑ তা কিন্তু নয়।

‘ভোক্তার কাঁধে বাড়তি করের বোঝা: উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথাগুলো বলেন অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি। নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ ২৪ ডটকমের আয়োজনে এই গোলটেবিল বৈঠক গতকাল বুধবার রাজধানীর গুলশানের এমসিসিআই সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

জাগো নিউজ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হকের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে বক্তব্য দেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ, রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য রেজাউল হাসান, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি নাজের হোসাইন, এসিআই ফুডসের প্রধান ব্যবসা কর্মকর্তা ফারিয়া ইয়াসমিন, এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন নাসির, বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম, অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা, সাবেক ব্যাংকার সাইফুল হোসেন ও সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন।

অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি এককভাবে কোনো ফলাফল আনতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে উঠিয়ে রেখেছে। এটি মূল্যস্ফীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি তার নিজের গতিতে চলছে। এতে বরং দেশের কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এটি ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিআইডিএসের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, অর্থনীতিতে যেসব নীতি নেয়া হচ্ছে সেগুলো একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পৃক্ততা নেই। খুব চিন্তাভাবনা করে নেয়া হচ্ছে না। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, সেই আশির দশক থেকে আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক যেসব প্রেসক্রিপশন দিয়েছে সেগুলো কোনো কাজ করেনি। সবগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এবারও ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রক্রিয়াগুলো সঠিক করতে হবে বলে মন্তব্য করেন মুস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই অর্থনীতির গতি বাড়াতে হবে। অর্থনীতি স্থবির করে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে আমরা সক্ষম হব না।
মূল প্রবন্ধ আলোচনায় বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বছরে কোটি টাকা আয় করেন, এমন ৬৭ শতাংশ মানুষ করজালের বাইরে। তিনি বলেন, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের আয় কোটি টাকার বেশি হলেও তাঁরা করজালে নেই। এমন ফাঁপা করজাল বা ক্ষুদ্র করজাল দিয়ে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানো যাবে না। সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে সরকার দুর্নাম নিল বলে মন্তব্য করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেয়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য থেকে গত ছয় মাসে ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি আছে। আইএমএফ চাপ দিচ্ছে রাজস্ব বাড়াতে। তাই করজাল না বাড়িয়ে সরকার পরোক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, রাজস্ব বাড়ানোর জন্য সরকারের অন্য কোনো বিকল্প ছিল কি না, তা দেখতে হবে। কারণ, শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানোয় ১১ হাজার বা সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব পাওয়া যাবে বলা হয়েছে। এতে রাজস্বের ঘাটতি তেমন একটা পূরণ হবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা রাজস্ব খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের প্রত্যাশা করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের উদ্যোগ নিলে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এসে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারবে। তিনি সম্পদ কর আরোপের পক্ষেও মত দেন।
বিকেএমই সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গণমাধ্যম থেকে শুনেছিলাম প্রতি রাতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেড় কোটি টাকা চাঁদা পেতেন। এখন তো পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজির কি পরিবর্তন হয়েছে? এখনো যাত্রাবাড়ীসহ অন্য বাজারে চাঁদাবাজি হচ্ছে, কারা করছে, এটা বন্ধ করতে হবে। এটা বন্ধ না হলে মূল্যস্ফীতি কমবে না, কারণ পণ্যের দাম বাড়তি থাকবে।

পরিবহনের চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের পণ্যের গাড়ি শরীফ মেলামাইন কাঁচপুর ব্রিজ নারায়ণগঞ্জের কয়েকটির পয়েন্টে আটকানো হয়। সেখানে হয়রানি করা হচ্ছে রপ্তানিকারকদের। এ পয়েন্টগুলোয় গাড়ি আটকে এলসির কপি, ইউডির কপি চাওয়া হচ্ছে অথচ সেগুলো সব সময় নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব। এরপরই জরিমানা করা হচ্ছে, যার কোনো কারণ নেই। এভাবে অন্যায়ভাবে হয়রানি বন্ধ করা হোক। এ কারণে শিপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অনেক ব্যবসায়ী সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানালেন আমি কথা বলি, সমাধানও হয়। সেটা কয়জনের সমাধান হবে, গতকালও ৩৯টি কোম্পানির গাড়ি আটকানো হয়েছিল হয়তো পাঁচ-ছয়জনেরটা ছাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এই হয়রানি বন্ধ করা হোক।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য জিরো ভ্যাট বলা হলেও নানান অজুহাতে ভ্যাট বসানো হয়। হঠাৎ এক ব্যবসায়ীর ১১ কোটি টাকার ভ্যাট রেডি করছে কোনো সই ছাড়াই। পরে সেটার নেগুসিয়েশনের জন্য বলা হয়, পরে হয়তো সেটা দু-তিন কোটিতে দাঁড়ায়। রপ্তানির স্বার্থে, দেশের ভ্যাটের নামে হয়রানি চান না ব্যবসায়ীরা।
খাদ্যপণ্যকে ভ্যাটমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, কর-ভ্যাটের জাঁতাকলে বিস্কুটের প্যাকেট আর কত ছোট করব আমরা? প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণ আর কত কমাব? এভাবে ছোট আর কমাতে কমাতে খালি প্যাকেট দিতে হবে। শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, দেশের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জন্য বিস্কুট একটি পুষ্টিকর খাবার। ভ্যাট বাড়ার ফলে প্রস্তুতকারকরা আর কম দামে বিস্কুট উৎপাদন করতে পারবেন না। আমরা এক মাস ধরে আন্দোলন করছি ভ্যাট কমানোর জন্য। এখনো মাঠে আছি। আশা করেছিলাম ড. ইউনূস সরকার এসে আমাদের বিষয়টা দেখবেন, কিন্তু সে আশাও ফিকে হয়ে যাচ্ছে। খাদ্যপণ্য ভ্যাটমুক্ত থাকা দরকার। অথচ উন্নত দেশ ইংল্যান্ডে খাদ্যপণ্য ভ্যাটমুক্তÑ বলেন তিনি।

মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এ বিস্কুটসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রীর ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন যে প্রতিষ্ঠান ১০ কোটি টাকা ভ্যাট দিচ্ছে, এর ফলে তাকে ৩০ কোটি টাকা দিতে হবে। তাহলে সে শিল্প কীভাবে টিকবে? এই ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, দেশের মধ্যে যারা ভ্যাট দেন তাদের ওপরই এর বোঝা চাপানো হচ্ছে। অথচ একটা বড় অংশ ভ্যাট নেটের বাইরে। আমাদের নেট বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে ভ্যাট কমানো জরুরি।

কর-ভ্যাটের হার যুক্তিযুক্ত করা হলে দেশ সুন্দরভাবে চলবে বলে মন্তব্য করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দরকার আছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বাড়াতে হবে।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, বর্তমান সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রব্যমূল্য কমানো। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও যখন সেটি করা গেল না তখন শুল্ক কমানো হলো। তবে নিত্যপণ্যের দাম তো কমলই না, উল্টো সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হলো। তখন আইএমএফ বলল রাজস্ব ঘাটতি থাকলে চতুর্থ কিস্তি তারা দেবে না। এই পরিস্থিতিতে সরকার কিছু পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে দিল। এসব পণ্যের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের ওপর চাপ পড়ে।

বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার না হলে প্রক্রিয়াজাত কৃষিখাত খুব বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে এসব খাবার গেলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা এমনিতেই বড় সমস্যায় আছি বেশ কয়েক বছর ধরে। আমাদের ১৬ শতাংশ ব্যাংকের সুদহার, দিনে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, গ্যাস থাকে না। কীভাবে টিকে থাকবো সে লড়াইয়ে অনেকে ব্যস্ত। বাড়িঘর বন্ধক দিয়ে ঋণ নিয়ে আমরা ব্যবসা করছি, তারপরও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেটা কাম্য নয়।

এম এ হাশেম বলেন, বিশ্বের প্রতিটি দেশে শুল্ককর বাড়ানোর আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। আমাদের দেশে সেটা হয়নি। বিগত সরকারও করেনি, এ সরকারও করেনি। আমাদের জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন মনে করে না। যখন খুশি তখন ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবেন, কোন দেশে বাস করছি আমরা? সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসায়ী সমাজেরও প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের আরও শক্তভাবে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।