আইএমএফ’র শর্ত বাস্তবায়ন: সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমছে

সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমছে। সব ধরনের সঞ্চয়পত্র স্কিমে নতুনভাবে এ হার পুনর্নির্ধারণ করছে সরকার। ধরন অনুযায়ী প্রথম ধাপে সাড়ে ৭ লাখ টাকার নিচে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপ সাড়ে সাত লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগকারীদের জন্য এ হার ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ অনুবিভাগ অনুমোদন দিয়েছে। নতুন সুদহার নির্ধারণের আদেশ জারি করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে (আইআরডি) অনুরোধ করেছে অর্থ বিভাগ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এর আগে গত জানুয়ারিতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছিল। যার মেয়াদ ৩০ জুন সোমবার শেষ হয়েছে। প্রথম দফায় সুদহার জানুয়ারিতে বাড়ানো হলেও অন্তর্বর্তী সরকার দ্বিতীয় দফায় এ হার কমিয়েছে।

আরও পড়ুনঃভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ এনবিআর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে

কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কয়েকটি শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানো। পাশাপাশি এর সুদহার নির্ধারণের ফর্মুলা হবে বাজারভিত্তিক। ফলে সরকার আইএমএফ’র শর্ত বাস্তবায়নের দিকে হাঁটতে গিয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমাচ্ছে।

একই কথা বলছেন বিশেষজ্ঞমহল। তাদের মতে, সুদহার হ্রাস করার ফলে এ খাত থেকে সরকার ঋণ কম পাবে। কারণ ব্যাংকগুলো এখন আমানত ও ফিক্সডিপোজিটের ওপর ভালো সুদ দিচ্ছে। এমন হতে পারে, এখন সুবিধাভোগীরা সঞ্চয়পত্রে টাকা না রেখে ব্যাংকমুখী হবে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের টান পড়তে পারে।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ জানান, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণের চাহিদার বেশির ভাগ মেটানো হচ্ছে ব্যাংক থেকে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা বারবার বলছে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে তাদের সমস্যা হচ্ছে। আমি মনে করি সুস্থ বিনিয়োগের স্বার্থে ব্যাংক থেকে না নিয়ে সরকারের ঋণ সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া উচিত। কিন্তু এখন মানুষ ব্যাংকে চলে যাবে কারণ সেখানে এফডিআর সুদহার সর্বোচ্চ ১২ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। মানুষ সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখবে না।

তিনি বলেন, নতুন বাজেটও সংকোচনমূলক করা হয়েছে। মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক বাজেটের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর নতুন উদ্যোগ সাংঘর্ষিক। এখানে সুদের হার কমানো ঠিক হয়নি। সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের চালু সঞ্চয় স্কিমের সংখ্যা ৯। এগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং ডাকঘর ফিক্সডিপোজিট সঞ্চয়পত্রের সুদহার পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাবটি অনুমোদন হয়েছে। নতুন নিয়মে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমায় দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে আছে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচের বিনিয়োগকারীরা। দ্বিতীয় ধাপে আছে এর ওপরের বিনিয়োগকারীরা।

পুনর্নির্ধারিত হারের ক্ষেত্রে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের প্রথম ধাপের বিনিয়োগকারীদের বর্তমান সুদহার ১২ দশমকি ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। আর দ্বিতীয় ধাপের বিনিয়োগকারীদের সুদহার ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে প্রথম বছরে সুদ পাওয়া যেত ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে, সেখানে নতুন হার ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ করা হয়েছে।

৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার প্রথম ধাপের বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের জন্য এ হার ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশে নেমে আসবে।

পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের বিনিয়োগে সুদহার ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে নেমে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী প্রথম বছরে এ স্কিমে সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা আগে ছিল ১০ দশমিক ২৩ শতাংশ।

এছাড়া পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমছে। এ স্কিমের সুদহার প্রথম ধাপের বিনিয়োগের জন্য ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে এ সুদের হার ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ ঠিক করা হয়।

সর্বশেষ পোস্ট অফিস ফিক্সডিপোজিটের সুদহার প্রথম ধাপের জন্য ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশে আনা হয়েছে। আর দ্বিতীয় ধাপের বিনিয়োগের জন্য ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

নতুন সুদহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি সুদহার কমছে ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক ও পোস্ট অফিস ফিক্সডিপোজিডের ক্ষেত্রে। এই দুটি স্কিমে টাকা বিনিয়োগ করলে প্রথম বছরে যেখানে আগে সুদ পেত ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, এখন পাবেন ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

মূলত আইএমএফের পরামর্শে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ছয় মাসের গড় ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্রেজারি বিলের সুদহার বাড়লে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়বে। আর ট্রেজারি বিলের সুদহার কমলে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমবে।

এদিকে সুদের হার গত জানুয়ারিতে বাড়ানোসহ বেশি কিছু সুবিধা দেওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতির মুখে পড়েও এ সময় সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন বিনিয়োগ না হলেও ভাঙানোর প্রবণতা কমায় নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় এসেছে। কিন্তু নতুন করে সুদহার কমানোয় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে অধিকাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় তাদের পক্ষে নতুন করে সঞ্চয় বা বিনিয়োগ কোনোটাই করার সামর্থ্য নেই।

ধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ