আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে এসএমইতে

দেশের ১ কোটি ১৮ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) উদ্যোক্তার ৯০ শতাংশই ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। নিজের মোবাইল ফোন থেকে কিংবা প্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনোভাবে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই উন্নত প্রযুক্তি ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)’ ব্যবহারের বাইরে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রযুক্তিগত অজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণের অভাব, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে উচ্চ ব্যয় (বিনিয়োগ), ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, ডিজিটাল অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনীহা- এইসব কারণে কেন এসএমই খাত প্রযুক্তি এবং এআই ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য গবেষণা দরকার হলেও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখাতে খুব বেশি টাকা খরচ করছে না। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫ শতাংশ এবং এসএমই খাতে ১-২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করছে। এটি শঙ্কা তৈরি করছে এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে।


ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ব্যাংকার ও পলিসি মেকারদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সহায়তা করবে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, এসএমই খাতে অর্থায়ন অনেক বড় সমস্যা। ব্যাংকে ঋণ পেতে অনেক ভোগান্তি পেতে হয় উদ্যোক্তাদের। তবে তাদের ঋণ শোধের হার ভালো। এ ব্যাপারে ব্যাংকার ও পলিসি মেকারদের এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সহায়তা করবে। এসএমইদের ডেটাবেজ ঠিক করার তাগিদ দিয়ে উপদেষ্টা আরো বলেন, এটা দ্রুত ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। হার্ডকপি থাকলে হবে না। শিল্প বাণিজ্যে এসএমই ভালো করলে, পুরো অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আরও পড়ুনঃ সিএমএসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের মেলা শুরু হচ্ছে কাল
রাঙামাটির উদ্যোক্তা সুপর্ণা তঞ্চঙ্গ্যা। পেশায় শিক্ষক। পেশার পাশাপাশি নিজেকে তৈরি করেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। গড়ে তুলেছেন কাঞ্চি ফ্যাশন হাউস। তিনি বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন সব কাজ করতে হচ্ছে। বাজারজাত করার জন্য আমার পণ্যগুলো সুন্দর করে ছবি তুলে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করি। যারা আগ্রহী হোন তাদের ঠিকানা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিই। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রযুক্তি দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুললে কাজগুলো আরো সহজভাবে করা যেত। এসএমই খাত যাতে আরো প্রযুক্তিনির্ভর হয়, সে বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা চান এই উদ্যোক্তা।


কাগজের তৈরি বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কাজ করছে জেডএফ হ্যান্ডিক্রাফট। প্রতিষ্ঠানটি তাদের বেশ কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করছে। জেডএফ হ্যান্ডিক্রাফটের পরিচালক (অপারেশন) এস এম মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নিজেরাই পণ্যের ডিজাইন করে থাকি। প্রযুক্তির ব্যবহার করি। ইন্টারনেট থেকে নিত্যনতুন ডিজাইন নিজেদের মতো করে তৈরি করে থাকি। তিনি বলেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রযুক্তি বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেইনি। তবে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে কীভাবে ইন্টারনেটের ডিজাইন ডাউনলোড করে কাস্টমাইজ করা যায় তা শিখেছি। ফলে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের জন্য পছন্দের পণ্য তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।


এসএমই ফাউন্ডেশনের জরিপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের ৮২ শতাংশ উদ্যোক্তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নন, আর ৬৬ শতাংশ জানেন না কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস বা আইওটি ব্যবসায় কাজে লাগতে পারে। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া ও এআইর ব্যবহার হলে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এসএমই খাতের অবদান যেখানে ৩০ শতাংশ আছে, সেটি আরো বেড়ে যেত। বিশ্বব্যাংকের ভিন্ন একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এসএমই খাতে প্রযুক্তির ঘাটতিতে প্রতিবছর ৩-৫ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। এদিকে এসএমই খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নীতিগত সহায়তাও খুব কম। জাতীয় ‘এসএমই নীতিতে’ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা ভিন্ন। উদ্যোক্তারা জানেন না কী প্রযুক্তি প্রয়োজন, কোথায় পাবেন, কীভাবে শুরু করবেন। এছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহার আরও কঠিন হয়ে গেছে কারণ আইসিটির ২৭ খাত করমুক্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরে তা ১৯-এ নেমেছে। কর-ভ্যাটের অভাব এবং অব্যাহতির সংকোচন প্রযুক্তি খাতে অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শব্দটি যতটা ছোট, এর গভীরতা অনেক বেশি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংক্ষিপ্ত রূপ হলো এআই। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি ব্যবহারে মানুষের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করে উন্নত থেকে উন্নত পরিসরে নেওয়া যায়। এসএমই খাতে এআই ব্যবহার ছোট পরিসরে কিছুটা শুরু হলেও বড় অংশ এর বাইরে রয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মুসফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এআই-এর সম্পৃক্ততা বাড়াতে ছোট ব্যবহারের ওপর উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে উদ্যোক্তাদের ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করে, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেকটা দূর হচ্ছে।


ইউরোস্ট্যাটের তথ্যমতে-ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় ক্ষুদ্র শিল্পে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ এবং মাঝারি শিল্পে ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ এআই ব্যবহার হচ্ছে। ডেনমার্ক সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। তাদের হার ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বেলজিয়ামে ২৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, রোমানিয়ার মতো দেশেও ৩ দশমিক ০৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে এআই। এছাড়া থাইল্যান্ডে ৪০ শতাংশ এসএমই এরই মধ্যে আইওটি ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় ডিজিটাল স্কিলস প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।


বিশ্বব্যাংকের ‘এন্টারপ্রাইজ সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশে মাত্র ১২% এসএমই ডিজিটাল টুল ব্যবহার করছে। তা-ও শুধু বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত। গ্রাম ও শহরতলির বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখনো রয়ে গেছেন পুরনো পদ্ধতির মধ্যে।


এদিকে এসএমই খাতে কিছু প্রতিষ্ঠানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা মতে, যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাদের বিক্রি ও সেবা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ। এসএমই খাত ‘কিফিয়া টেকনোলজি একটি ‘ক্রেডিট স্কোরিং পদ্ধতি’ নিয়ে এসেছে। এআই-এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে এসএমই খাতে নারীদের জামানতবিহীন ঋণ দিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে ব্যাংকগুলো। এআই প্রযুক্তি দিয়ে এসএমই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সক্ষমতা, জামানত ও গ্যারান্টির স্কোর নির্ধারণ করা হবে। এটি উদ্বোধন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। বিশেষ করে এআই ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ভালো সুযোগ রয়েছে।


প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিফিয়া ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজির সিইও মুনির দুরি বলেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) ঋণমান নির্ধারণ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে নারী উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত, গ্যারান্টি ও আর্থিক রেকর্ডের ওপর নির্ভরশীল। এসব শর্ত পূরণ করতে না পারায় ঋণ পেতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় নারী উদ্যোক্তাদের। সে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।


বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বলেন, এশিয়ান মিরাকল দেশ হিসাবে খ্যাত চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান-এসব দেশের অর্থনীতির ডায়নামিক খাত হচ্ছে এসএমই। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন রোবট, এআই-এসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এসএমই খাতে প্রযুক্তিকে অবহেলা করা যাবে না এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মার্কেটিংয়ে কিছুটা এআই ব্যবহার হচ্ছে। কিছু প্লাস্টিক শিল্প এআই ব্যবহার শুরু করেছে। সেভাবে ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে।

এধরনের খবর পড়তে ভিজিট করুন সোনালি বাংলা নিউজ