আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ, অনিরাপদ হচ্ছে নারীর পথচলা

নর যদি রাখে নারীরে বন্ধী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে
যুগের ধর্ম এই কবি নজরুল ইসলাম

আজ বুধবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর কৃতিত্বকে স্মরণ ও সম্মান জানাতে এ দিনটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় দেশব্যাপী উদযাপন উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর আমাদের দেশে নারী দিবসকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন সভা, সেমিনার, র‌্যালি, পোস্টার প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হয়, যা সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক হলেও সমাধান হয় না। বরং দিন দিন নারীর পথচলা আরো বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই নারীরা আজও নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সমাজে একদিকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটলেও নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও শোষণ অব্যাহত রয়েছে। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনপরিসরে নারীরা প্রায়ই বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতন আজও আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত।
‘কোটা না মেধা’ এই বিষয়টিকে ঘিরে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। বৈষম্য দূর করতে সেই আন্দোলনে ছাত্রজনতার পাশাপাশি অসংখ্য নারীরাও অংশ নিয়েছিলেন। দেশে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এলেও নারীরা অবহেলিতই রয়ে যায়। জুলাই আন্দোলন তৈরি হয়েছিল যে বৈষম্য দূর করতে, আজ সেখানে নারীরা অনেক বেশি বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী গত ৭ মাসে ঢাকার শ্যামলীতে যৌনকর্মীদের ওপর হামলা, লালমাটিয়ায় দুই শিক্ষার্থীর ওপর জনসমক্ষে নির্যাতন ও হয়রানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পোশাক নিয়ে শিক্ষার্থীকে হয়রানির ঘটনা, রংপুর ও জয়পুরহাটে মেয়েদের ফুটবল মাঠে আক্রমণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের ওপর অব্যাহত নিপীড়ন এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নারীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনের হয়রানির চিত্র দেখা যাচ্ছে।
নারীর প্রতি অন্যায়, অবমাননার দায়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠীত হয়েছে। বক্তারা বলেন, নারীদের প্রতি সহিংসতার পাশাপাশি দেশের অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও প্রতিশোধমূলক হামলা, হুমকি ও সংগঠিত মব এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সমাবেশে বক্তারা জানান, মুক্তির আন্দোলনে নারীর সক্রিয় ভূমিকা বাংলাদেশে নতুন নয়। এমনকি বাংলাদেশের জন্মেরও আগে যত বিপ্লব, যত গণ-অভ্যুত্থান, যত স্বাধীনতা আন্দোলন এই অঞ্চলে হয়েছে, তার সবখানেই নারীর উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে, প্রাণের তাগিদে নারী বারবার রাজপথে নেমে এসেছে। মুক্তি অর্জিত হওয়ার পর কেন নারী বারবার দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে তা দীর্ঘ আলাপ এবং বিশ্লেষণের বিষয়। আদতেই বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চাইলে এই আলাপের বিকল্প নেই। শুধু শারীরিকভাবে নারী গুটিকয় মানুষকে দিয়ে যে নারীর মুক্তি সম্ভব নয় তা অতীতের ক্ষমতাশালী নারীদের দিয়ে আমরা দেখেছি সে রাজনীতিতে হোক বা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে।
দেশে নারী নির্যাতন বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৯। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ নারীদের। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক, এই নারীরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি নির্যাতনের প্রধান ধরনের মধ্যে ধর্ষণ সবার শীর্ষে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই সময়কালে দেশে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৭ হাজার ৪৭৯টি, যার মানে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। একই সময়ে দেশে ৫৯ হাজার ৯৬০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাকে প্রকাশ করে না, বরং সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার অক্ষমতা এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরে। ২০২৪ সালে যৌতুকের দাবিতে ৩৬ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন, যা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয়।
দেশে কন্যাশিশুরাও নিরাপদ নয়। ২০২৪ সালে ২২৪টি কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যদিও অনেকেই মনে করেন, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ, অধিকাংশ সময় শিশুরা এ ধরনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে ভয় পায়। একই বছরে ধর্ষণের পর ৮১টি কন্যাশিশুর হত্যার ঘটনা ঘটে এবং ১৩৩টি কন্যাশিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এ পরিসংখ্যান বাংলাদেশের নারীদের বর্তমান পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরছে। তাঁরা পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি বাইরে বের হলেও ধর্ষণ ও সহিংসতার মতো ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
নারী দিবসের শুরুÑ ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ এই দিনটির শুরু। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেপ্তার হন বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হন অনেকেই। তিন বছর পরে ১৮৬০ সালের একই দিনে গঠন করা হয় ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’।
১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়েছিল। আমেরিকার তৎকালীন সক্রিয় সোশ্যালিস্ট পার্টি ১৫,০০০ নারীর স্মরণে দিনটি উদযাপন করেছিল। যারা কঠোর কাজের বিনিময়ে কম মজুরির বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে প্রতিবাদ করেছিল। এই দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে পালনের চিন্তাটা মাথায় আসে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ও সমাজতান্ত্রিক কর্মী ক্লারা জেটকিনের। তিনি তার এই চিন্তাটা জানান ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে নারী শ্রমিকদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সেখানে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী উপস্থিত ছিলেন, এবং তারা সর্বসম্মতিক্রমে তার এই প্রস্তাব মেনে নেন।
তবে ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের এক মিলিয়নেরও বেশি লোক আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছিল। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর দুই বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এই দিবসের শতবর্ষ উদযাপিত হয় ২০১১ সালে।