কমপ্লায়েন্স ও আন্তর্জাতিক সনদের অভাবে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না: ডিসিসিআই সভাপতি

তৈরি পোশাক খাতের পর বাংলাদেশে রপ্তানির দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস চামড়া খাতে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এলডিসি পরবর্তী সময়ে এখাতে প্রাপ্ত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো ক্রমাগত হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ এখাতে নিজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি, কারণ বৈশ্বিক চামড়া শিল্পে আমাদের অবদান ১%-এর কম অবদান রেখেছে। এমন বাস্তবতায়, এলডিসি পরবর্তী সময়ে এখাতের রপ্তানিতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদের দক্ষতার উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, নতুন পণ্যের উদ্ভাবন, ভ্যালুচেইন শক্তিশালীকরণ, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারিখাতের সহযোগিতার উপর জোরারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি চামড়া শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে একটি সহায়ক অবকাঠামো তৈরির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যার ভিত্তিতে বেসরকারিখাত আগামী ১০বছরে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, ২৫ মে, ২০২৫ তারিখে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত “চামড়া শিল্পের কৌশল নির্ধারণ; এলডিসি পরবর্তী সময়ে টেকসই রপ্তানি” শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এ অভিমত জ্ঞাপন করেন। ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত উক্ত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এছাড়াও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর চেয়ারম্যান মোঃ সাইফুল ইসলাম এবং এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মোঃ হাফিজুর রহমান এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, চামড়া শিল্পের বিদ্যমান নানাবিধ প্রতিকূলতা নিরসনে শিল্প মন্ত্রণালয় সহায়ক নীতি পরিবেশ প্রদানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, যার মাধ্যমে এখাতে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন নিশ্চিতকরা সম্ভব হবে। এখাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ করতে হবে বলে শিল্প উপদেষ্টা মত প্রকাশ করেন। চামড়া শিল্পের সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি বিস্তৃত ইকো-সিস্টেম প্রবর্তনের উদোগ গ্রহণ করেছে বলে তিনি অবহিত করেন। এছাড়াও উপদেষ্টা বলেন, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে চামড়া শিল্পের পরিবেশগত অবকাঠামো উন্নয়ন, সনদ প্রাপ্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে তাঁর মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

বিসিক চেয়ারম্যান মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, চামড়া খাতে সিইটিপির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, সাভারে স্থাপিত সিইটিপি’র ক্যাপাসিটি বর্তমানে ১৪ হাজার কিউবিক মিটার এবং পিকসিজনে (কুরবানীর সময়) এখাতে চাহিদা থাকে ৩২-৩৫ হাজার কিউবিক মিটার, সিইটিপির সক্ষমতা ২০-২৫ হাজার কিউবিক মিটারে উন্নীতকরণে একটি টেকনিক্যাল টিম কাজ করছে। তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে ৬টি প্রতিষ্ঠানকে ইটিপি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, আরো ৮-১০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এখাতে পরিবেশ দূষণ রোধে কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে উদ্যোক্তাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, সেই সাথে ব্যক্তি পর্যায়েও সঠিকভাবে চামড়া সংরক্ষণে সচেতনতা বাড়ানোর উপর তিনি জোরারোপ করেন। চামড়া খাতে নতুন বাজার তৈরি, উদ্ভাবন ও পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

এফবিসিসিআই’র প্রশাসক মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, বহির্বিশ্বে এ শিল্পের ইমেজ সংকট রয়েছে, সেখান থেকে থেকে আমাদেরকে বের হতে হবে। তিনি জানান, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট না থাকার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগ যেমন পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি থেকে উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, সিইটিপি থাকলে সম্মিলিতভাবে ব্যয় কম হবে এবং মনিটর করা সহজ হবে এবং যেকোন ভাবেই এর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এখাতে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এলডব্লিউজি সার্টিফিকেট প্রাপ্তি সহজ হবে এবং এফডিআই আকর্ষন সহজ হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন, যেহেতু আমাদের প্রচুর পরিমাণে কাঁচামাল রয়েছে। তিনি বলেন, তৈরি পোষাক খাতের মত রপ্তানিমুখী সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন এবং তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন পরিলক্ষিত হবে।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেদারগুডস্ অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং এমসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ হতে সাভারে স্থানান্তর করা হলেও সিইটিপি পুরোপুরি চালু করা যায়নি, ফলে এখাতের কাঙ্খিত রপ্তানি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এলডব্লিউজি-এর মতো আমাদের আন্তর্জাতিক কোন সনদ না থাকায় বৈশ্বিক বাজার বাংলাদেশ প্রতিযোগী হয়ে উঠছে না এবং এখাতের উৎপাদিত পণ্যের ভালো মূল্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে, এছাড়াও চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সের অনুপস্থিতির বিষয়টিও অন্যতম কারণ বলে তিনি অবহিত করেন। চামড়া খাতের রুগ্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান এবং যারা এখাত হতে বের হতে আগ্রহী, তাদেরকে প্রস্থানের সহজ সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে, যাতে বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ প্রাপ্তি সহজতর হয়। চামড়া শিল্পের বার্ষিক রপ্তানি ১.২ হতে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে ঘুরপাক খাচ্ছে, তবে তৈরি পোষাকখাতের মত আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এখাতে বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভব, যা ২০৩৫ সালে ১০ বিলিয়নেও উন্নীত হতে পারে। চামড়া খাতের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ক্লাইমেট ফাইন্যান্স ফান্ড হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তিতে সরকারকে এগিয়ে আসার জন্য তিনি আহ্বান জানান। নাসিম মঞ্জুর আরো বলেন, চামড়া শিল্পটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তাই এটিকে একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ডব্লিউটিও অনুবিভাগ) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর মহাপরিচালক মোঃ আরিফুল হক, বিসিএসআইআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সালমা আহমেদ, বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মোঃ নুরুল ইসলাম, বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান, জেনিস সুজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নাসির খান এবং অস্টান লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা অংশগ্রহণ করেন।
ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ আসবেই, এগুলো যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে পারলে অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি পরিবেশ ও শ্রম খাতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতের জন্য বেসরকারিখাতের প্রতি আহ্বান জানান। সিইটিপি’র সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকার ও বেসরকারিখাত একযোগে কাজ করতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন
বিডার মহাপরিচালক মোঃ আরিফুল হক বলেন, আগামী ১৫বছরে আমাদের অর্থনীতি দ্বিগুন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় জরুরী। তিনি বলেন, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সহায়তার জন্য আমাদেরকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষন করতে হবে। তিনি জানান, সম্ভাবনাময় খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে বিডা গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করছে, যার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি বিডা কর্তৃক প্রবর্তিত হিটম্যাপে চামড়া খাতকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে এবং এলক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্স অনুসরণে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি এবং এখাতের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। এছাড়াও তিনি চামড়া শিল্পে ব্যক্তিখাতে প্রতিষ্ঠানে ইটিপি স্থাপনে গ্রীণ ফান্ড হতে স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তার আহ্বান জানান।
অস্টান লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইবনুল ওয়ারা বলেন, এখাতে সাপ্লাই চেইন বিশেষকরে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অনুপস্থিতির কারণে কাঁচামাল সহ অন্যান্য সবকিছুই আমদানি নির্ভর এবং আমদানি নির্ভরতা দিয়ে বেশিদিন বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব নয়, তাছাড়া আমাদের এলডব্লিউজি সনদও নেই। চামড়া খাতে আমাদানিকৃত পণ্য আনার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে রপ্তানির লীড টাইম বেড়ে যাচেছ, ফলে প্রতিনিয়ত আমরা বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছি বলে তিনি সভায় মত প্রকাশ করেন।
জেনিস সুজ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নাসির খান বলেন, সাপ্লাইচেইনের অনুপস্থিতি ও কাস্টমস জটিলতার কারণে রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তিনি বলেন, এখাতের পণ্যের মূল্য সংযোজনের সুযোগ করে দিলে স্বল্প সময়ে বার্ষিক রপ্তানি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।
বে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউর রহমান চামড়া খাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইটিপি স্থাপনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান, সেই সাথে ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য সিইটিপি ব্যবহার নিশ্চিতে সরকারের সহযোগিতার উপর জোরারোপ করেন। বিদ্যমান শুল্ক ও কর ব্যবস্থাপনার সংষ্কারের পাশাপাশি নীতি সহায়তা না দিলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষন কঠিন হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ কোরবানীর পশুর চামড়ার সঠিক মূল্য নির্ধারণের উপর জোরারোপ করেন।
ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মোঃ সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।