কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জন্য?

বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, যে দলটি টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল— বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী জনতার আন্দোলনে গত আগস্ট থেকে তছনছ অবস্থায় আছে। দলের সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন, দলের অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের সবাই রয়েছেন আত্মগোপনে।

সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গত জুলাই মাস থেকে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা, কিন্তু বিক্ষোভ দমনে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পুলিশ কঠোর ভূমিকা নেওয়ার এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে।

পুলিশকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে সেই আন্দোলনও দমন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে গমনের মধ্যে দিয়ে চুড়ান্ত পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। তবে তার আগে প্রায় দু’সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে দেশজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় এক হাজার মানুষ, আহত হয়েছেন আরও কয়েক হাজার।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর একটি অন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস হয়েছেন সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।

শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গা-ঢাকা দেওয়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু কার্যালয়ে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করেছে স্থানীয় জনতা। গত প্রায় দু’মাসে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা হয়েছে শতাধিক হত্যা মামলা।

এদিকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও এই সরকারের সমর্থকদের আহ্বান দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত প্রায় দু’মাসে শেখ হাসিনা এবং তার অনুগত নেতা-কর্মী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ জমা পড়েছে এবং আইসিটি সেগুলোর তদন্ত শুরু করেছে।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তবর্তী সরকারের সমর্থকরা শেখ হাসিনার বিচারের যে দাবি তুলেছে, তাকে সমর্থন জানিয়েছে জার্মানির প্রথমসারির থিঙ্কট্যাংক সংস্থা জার্মান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটির জ্যেষ্ঠ গবেষক জাসমিন লোর্চ।

দেশটির সরকারি সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশের গত ১৫ বছরের গোটা সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘণ, বিচার-বহির্ভূত হত্যা, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তাই আমি মনে করি, মানবাধিকার লঙ্ঘণ বিষয়ক যেসব অভিযোগ বাংলাদেশের বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আসছে, অবশ্যই সেগুলোর তদন্ত প্রায়োজন।

তিনি আরও বলেন, “এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তাতে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে— এমন সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তবে তাই বলে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগুলোর তদন্ত করা যাবে না কিংবা থেমে থাকবে— এমনটা হওয়া উচিত হবে না।”

বিগত জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ এবং বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন, ইতোমধ্যে সেসব ঘটনা তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন। সম্প্রতি ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিনিধিরা সফরও করে গিয়েছেন।

জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের এই সফরকে স্বাগত জানিয়ে লোর্চ বলেন, “এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যদি তদন্ত পরিচালিত হয়, তাহলে তা নিরপেক্ষ হবে।”

“আমি তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দিচ্ছি আরও একটি কারণে। সেটি হলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘণ হলে এসব তদন্তের ফলাফল তার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।”

শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর গত এক মাসে তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য ও উচ্চপর্যায়ের নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, অল্প কয়েক জন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ ছেড়ে পালাতে সফল হয়েছেন আর বাকিদের সবাই বর্তমানে দেশের ভেতরেই গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।

সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ডয়েচে ভেলে বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক জন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, কিন্তু তাদের কেউই সাক্ষাৎকার দিতে চাননি। সাক্ষাৎকার দিতে না চাওয়ার প্রধান কারণ— তারা ভয় পাচ্ছেন যে এখন সাক্ষাৎকার দিলে বর্তমান সরকার তাদের অবস্থান জেনে যাবে।

শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর পর ডয়েচে ভেলেকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। সেই সাক্ষাৎকারে জয় বলেছিলেন, “এটা ঠিক যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেসবের অনেকগুলোই ভুল ছিল; কিন্তু এটাও সত্য যে আন্দোলনকারীরা সরকারকে লাগাতার উসকানি দিয়ে গেছে।”

“আমাদের দলের অনেক নেতাকর্মীর ওপর হামলা হয়েছে, অনেকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটি ব্যাপার হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক সমর্থক প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে আওয়ামী লীগ ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ‍বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এখন চুপচাপ থাকলেও আওয়ামী লীগ মরে যায়নি, দুর্বলও হয়নি।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে রাজনীতি এবং প্রশাসনে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এই সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জয়। ডয়েচে ভেলেকে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো আলোচনা এখনও হয়নি। আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে তারা যদি দেশের সংস্কার করতে চান, তাহলে সেটি অসম্ভব।”

বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান এ প্রসঙ্গে ডয়েচে ভেলেকে বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে দল বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সংস্কারকাজে তাদেরকেও যুক্ত করা হলে তা হবে পুরোপুরি হাস্যকর একটি ব্যাপার।”

“তবে এটাও সত্য যে আওয়ামী লীগকে কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়। তাই সামনের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগকে অংশ না নিতে দেওয়া হয়, তাহলে অনেক প্রশ্নের জন্ম হবে।”

সেই সঙ্গে জাহেদুর রহমান আরও বলেন যে শেখ হাসিনা তার জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারবেন— এমনটা তিনি এবং বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন না।

“শেখ হাসিনা যদি দেশে ফিরেও আসেন, সেক্ষেত্রে ‘তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন’- এই দুর্নাম সর্বক্ষণ তাকে তাড়া করে ফিরবে। আমি এবং বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, ভারতে নির্বাসিত অবস্থাতেই জীবনাবসান ঘটবে তার।”

সূত্র : ডয়েচে ভেলে