কুরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে অস্থির মসলার বাজার। পুরো মসলার বাজারই সিন্ডিকেটের কবলে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন মসলার দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব মসলা আমদানি হয়েছে তিন থেকে চার মাস আগে। আর চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত আমদানি হওয়ায় এ মুহূর্তে বাজারে মসলার কোনো সংকট নেই বলে দাবি কাস্টমসের। তারপরও মসলার প্রতিটি আইটেমের দাম বেড়েছে। বেশির ভাগ মসলার দাম কেজিতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে চাল-ডাল-আটাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সে তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে লবঙ্গ, মরিচ, হলুদ, ধনিয়াসহ বিভিন্ন প্রকারের মসলা।
ভোক্তাদের অভিযোগ, কুরবানিতে মসলার চাহিদা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চাহিদাকে পুঁজি করে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সব মিলিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টন মসলাপণ্য আমদানি করা হয়েছে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার সংকট ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে মসলার দাম অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মসলাজাতীয় পণ্যের দাম দুই কারণে বাড়ছে। প্রথমত, দেশে এখন চলছে ডলার সংকট। ডলারের অভাবে এলসি করা যাচ্ছে না। একইভাবে বেড়েছে ডলারের দামও। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে মসলার দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারেও। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম।
মসলা গবেষণাকেন্দ্রের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে মসলার চাহিদা ৩৩ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২৭ লাখ টনের বেশি। বাকি মসলা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশ মসলা স্থলপথে আমদানি করা হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। আবার সমুদ্রপথে আসা মসলা দেশে প্রবেশ করে তিন বন্দর দিয়ে। অবশ্য সমুদ্রপথে আসা সিংহভাগ মসলা দেশে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই।
গত সপ্তাহে লবঙ্গের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। শুক্রবার একই লবঙ্গ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। গত সপ্তাহে প্রতিকেজি জিরা বিক্রি হয়েছিল মানভেদে ৫৫৭ টাকায়, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। গত সপ্তাহে যে গোলমরিচ প্রতিকেজি ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, এখন তা ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি দারুচিনি ৪০০ টাকা, হলুদ ৩৫০ টাকা, কালিজিরা ৩২০ টাকা, কিশমিশ ৮০০ টাকা, তেজপাতা ১২০ টাকা আর সাদা সরিষা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। কেজিতে ৫০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি জয়ত্রী বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে ভালোমানের ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দামে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। যা আগে ছিল ৪০ টাকার কমে। তবে এলাচের দাম কিছুটা কমেছে। ৪ হাজার ৮০০ টাকা বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা দরে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত দশ মাসে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে এক লাখ ৭০ হাজার ৮৩৪ দশমিক ৪২ টনের কাছাকাছি মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি করা হয়েছে। রসুন আমদানি হয়েছে ৯৯ হাজার ৮৫৮ টন। এছাড়া এলাচ আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬১৪ দশমিক ৬ টন, দারুচিনি ১০ হাজার ৫৪৩ টন, লবঙ্গ ২ হাজার ১৫৪ টন, জিরা ৩ হাজার ৭০২ টন, পেস্তাবাদাম ৮২৭ টন, কেশিয়া পাউডার ৩৭৫ টন, কিশমিশ ৪ হাজার ৮২৩ টন, শাহী জিরা ২ টন, জয়ত্রী ২৯০ টন, কাবাব চিনি ২ টন, জায়ফল ২৭২ টন, কালিজিরা ৭ টন, গোলমরিচ ১ হাজার ৯ দশমিক ৭২ টন, মেথি ৭২ টন, আদা ২১ হাজার ১৯ টন, পেঁয়াজ ১৪ হাজার ৬৩ দশমিক ৬ টন, হলুদ ৪ হাজার ৩২৮ টন, শুকনা মরিচ ১৭৯ দশমিক ৭ টন, ওয়ালনট ১৭৫ টন, অনিয়ন পাউডার ৪৩৯ টন, জিনজার পাউডার ৩৭ দশমিক ৮ টন, গারলিক পাউডার ৭৩২ টন, পি-নাট ৮৮ টন, ড্রাই অনিয়ন লিভ ১৩৮, কোকোনাট ফ্যাট ৮৮৮, কেশিও নাট ৯৮৫, মৌরি ৭১২ টন আমদানি করা হয়েছে।
কাস্টমসের কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণে মসলাজাতীয় পণ্য আমদানি করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব কাস্টমস থেকে পণ্য খালাস করা হচ্ছে। যাতে বাজারে কোনো ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়। মূলত ভারত থেকে জিরা ও এলাচ, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও গুয়েতেমালা থেকে দেশে লবঙ্গ ও দারুচিনি আমদানি করা হয়।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, নানা কারণে বাজারে কিছু কিছু মসলার দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও মসলার দাম বেড়েছে। মসলাকে বিলাসবহুল পণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাই এ পণ্য আমদানিতে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয়। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়ায় মসলার বাজার চড়া।