দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অব্যাহত চাপের মুখে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসহ সরকার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে, এর মধ্যেই রাজপথে নামেন চাকরিপ্রত্যাশী, সাত কলেজসহ তিতুমীর শিক্ষার্থীরা। তাদের বহুমুখী দাবিতে আন্দোলন যেন সরকারের জন্য গলায় ফাঁসের অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চতুর্মুখী এ আন্দোলন শুধু সরকারের জন্যই অস্বস্তিকর নয়, পুরো রাজধানীবাসীর জন্য নিত্যদিনের সীমাহীন দুর্ভোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেখানে কেউ দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়, গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ধারেকাছে ভিড়তে না পারলেও বর্তমানে এসব বাসভবন-কার্যালয়কে ঘিরেই প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আন্দোলনের। এমনকি এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদ কর্মসূচি ঠেকাচ্ছেও না অন্তর্বর্তী সরকার। এতে করে সৃষ্ট যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভুগতে হচ্ছে নগরবাসীকে। লাখো মানুষ অফিস শেষে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।
রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরকারি তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এর পর বেলা ১১টার দিকে কলেজটির সামনের রাস্তা আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। ফলে মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত রাস্তার যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে হঠাৎ করে রাস্তা বন্ধ করার পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাত্রীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হলেও তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন।
একপর্যায়ে দুপুরের দিকে বিশ্ব ইজতেমার কথা চিন্তা করে ‘ব্লকেড টু নর্থ সিটি’ নামের পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচি শিথিল করেন আন্দোলন করা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে জুলাই আন্দোলনে আহতদের পুনর্বাসন, ক্যাটাগরি পদ্ধতি বাতিলসহ দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আজ (রোববার) সকালে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত বেশ কয়েকজন। এর কিছুক্ষণ পরই আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবন, ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে অবস্থান নেন আহতরা। এসব এলাকা দিয়ে যানবাহন যেতে দেওয়া হয়নি। শুধু রোগী বা অ্যাম্বুলেন্স দেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় এই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, দেখা দেয় তীব্র যানজট।
এরপর দুপুরের দিকে শিশুমেলার সামনে মিরপুর-ধানমন্ডি সড়কও অবরোধ করেন গণঅভ্যুত্থানে আহতরা। ফলে সড়কটির সবদিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। আহতদের মধ্যে সাব্বির নামে একজন আজকের দিনের পরিস্থিতি দেখে দাবি আদায়ে লক্ষ্যে আগামীকাল সচিবালয়ের দিকে যাওয়ারও ঘোষণা দেন।
এছাড়াও আজ দুপুর ১২টার পর থেকে রাজধানীর হাইকোর্ট মাজার চত্বরে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি হারানো পুলিশ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
এমনকি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে নৃশংস জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সেইফ এক্সিট দেওয়ার প্রতিবাদে ও ব্যর্থতার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে রোববার দুপুর ২টা থেকে রাজু ভাস্কর্য থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের।
জানা গেছে, শুধু আজকের দিনেই ৬/৭টি আন্দোলন কর্মসূচি রয়েছে। এছাড়া গত তিন দিনে ঢাকায় অন্তত এমন প্রায় ২০টি বিক্ষোভ, মানববন্ধন, ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়।
এদিকে রাজধানীতে নানামুখী আন্দোলনের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। এমনকি লাগামহীন এসব আন্দোলনের ফলে বেচাকেনাও বন্ধ হয়ে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় আইন করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ক্ষোভ প্রকাশ করে আফজাল হোসেন নামে এক পথচারী বলেন, শাহবাগ যাব বলে মিরপুর থেকে বাসে উঠেছি। আগারগাঁও পর্যন্ত এসে দেখি রাস্তা বন্ধ। দুই দিন পরপর এখানে কোনো না কোনো আন্দোলন হয়। এর আগেও শিক্ষকরা আন্দোলন করেছে, শুনেছি তিতুমীরের শিক্ষার্থীরও আন্দোলন করছে। ঢাকা শহর এখন আন্দোলন আর দাবি আদায়ের শহর হয়ে গেছে।
শুধু যাত্রীরাই নয়, ভোগান্তিতে পড়েছেন গণপরিবহনে চালক ও সহকারীরাও। রজনীগন্ধা পরিবহনের চালক ফজল মিয়া বলেন, রাস্তা বন্ধ দেখে যাত্রীরা নেমে গেছে। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার উপায় নাই। সকাল থেকে বাস নিয়ে এখানে বসে আছি। আর কতক্ষণ থাকতে হবে আল্লাহ জানেন।
এদিকে এসব আন্দোলন-কর্মসূচি প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকারকে হঠানো হয়েছে। তখন নানান মানুষ বৈষম্য ও অন্যায়ের শিকার হয়েছেন। নতুন সরকার এ বৈষম্য দূর করতেই কাজ করছে। মানুষের দাবিদাওয়া থাকা যৌক্তিক, তবে তার আগে কিছু সময় দেওয়া উচিত।