নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়ার পরিকল্পনা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাজেটের এ আকার চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমায় আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে। ৫৪ বছর পর এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট করতে যাচ্ছে সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকুচিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয় কমানো ও বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য করতেই আকার কমানোর কথা বলছে অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতে হ্রাসকৃত করহার উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। পাশাপাশি পোশাক খাতের কর সুবিধা তুলে নিতে পারে সরকার।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতের কর সুবিধা উঠিয়ে নিতে আগামী বাজেটে এ সংক্রান্ত তিনটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) বাতিল করা হচ্ছে। এসব খাতে সাধারণ করহার প্রযোজ্য হবে। তবে প্রান্তিক মৎস্যচাষিদের সুরক্ষা দিতে ৫ লাখ বা সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার প্রস্তাব রাখা হতে পারে। এ কর সুবিধার আড়ালে অনেকেই কালো টাকা সাদা করেন বলে দাবি এনবিআর সংশ্লিষ্টদের। সুবিধার অপব্যবহার রোধে এসআরওগুলো বাতিল করা হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধা দিতে ২০১৫ সালে কর সুবিধা দেয়া হয়। পরে দেখা গেছে মন্ত্রী-এমপিরা খামারকে মূল আয় দেখিয়েছেন আয়কর নথিতে। এগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। নির্বাচনী হলফনামায় দেখা গেছে, মন্ত্রী-এমপিরা কেউ মাছ ব্যবসায়ী, কেউ মুরগি ব্যবসায়ী। এ সুবিধা আগামী বাজেটে থাকবে না।
কর্মকর্তরা আরো জানান, পোশাক কারখানায় অস্থিরতা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, শিল্পকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সংকটের মুখে দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানিখাত পোশাকশিল্প। বাজেটে পোশাক শিল্পের করহার বাড়ানো হতে পারে। এতে পোশাক খাতের রপ্তানিতে আরও বাধা সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের করপোরেট করহার ১২ শতাংশ। সবুজ কারখানার জন্য এ হার ১০ শতাংশ। আর সুতা শিল্পের করহার ১৫ শতাংশ। সুতার ওপর কর অপরিবর্তিত থাকলেও পোশাক খাতে করহার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পোশাক খাতে করহার বাড়িয়ে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ করতে চায় এনবিআর। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সদস্য (করনীতি) এ কে এম বদিউল আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কর সুবিধা ভোগ করে আসছে পোশাক খাত। অন্যান্য খাতের সঙ্গে করপোরেট করহারে বৈষম্য দূর করতে এনবিআর এ বিষয়ে ভাবছে। এখনো কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাজেটে করপোরেট করহার বাড়ানো এ খাতের জন্য অবিচার হবে। ১২ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা আরো বেশি করপোরেট কর দেই। সরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম কর আদায় করে। সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। এই মুহূর্তে করহার বাড়ানোও হবে অযৌক্তিক। সরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অগ্রিম কর আদায় করে। সেই টাকা আর ফেরত পাওয়া যায় না। এই মুহূর্তে করহার বাড়ানোও হবে অযৌক্তিক।
বর্তমানে অর্থ আইন ও এসআরওর মাধ্যমে বিভিন্ন খাতের জন্য বিভিন্ন রকমের করপোরেট করহার নির্ধারণ করা আছে। এনবিআরের পরিকল্পনা একক হারে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে কর আদায় করা। একক হারে করপোরেট কর ও ভ্যাট নির্ধারণ করতে উল্টো ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব দিতে পারে এনবিআর। সেক্ষেত্রে ভ্যাটের হার হতে পারে ১৫ শতাংশ, আয়করের হার এখনো চূড়ান্ত করেনি এনবিআর। শিগগির প্রাক-বাজেট আলোচনার চূড়ান্ত সভা হবে এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে। সেখানে এই প্রস্তাব দিতে পারে এনবিআর।
বর্তমানে সিগারেট-বিড়ি-জর্দা-গুলসহ তামাকজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে ৪৫ শতাংশ, ট্রাস্টের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১০ শতাংশের কম শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে হস্তান্তর হওয়া পাবলিক ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ, কোম্পানি আইনের অধীন এক ব্যক্তি কোম্পানির ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, নন-পাবলিক ট্রেডেড ব্যাংক, বিমা, ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, মার্চেন্ট ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, অস্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ব্যক্তিসংঘের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, সমবায়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, পাটজাত শিল্পের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ, শাখা-লিয়াজোঁ অফিস ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার ক্ষেত্রে করহার ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে শর্ত পূরণ করলে কিছু ক্ষেত্রে করহার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
এনবিআর সংশ্লিষ্টদের দাবি, পোশাকখাত যদি ১২ শতাংশের বেশি কর দেয় তাহলে স্ট্যান্ডার্ড রেটে কর দিতে আপত্তি কোথায় তাদের? অটোমেশন হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আগামীতে নিজের অ্যাকাউন্টে অগ্রিম কর ফেরত পাবেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, করপোরেট করহার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে এনবিআরের সরে যাওয়া উচিত হবে না। কর খাতের সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে বিভিন্ন ধরনের নগদ সহায়তা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।
আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সিপিডি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তবে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না। ব্যক্তি শ্রেণির ন্যূনতম কর বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে সরকারের। সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া সারাদেশের সবার জন্য ন্যূনতম কর একই সমান করা কিংবা কাঠামো আগের মতো রেখে ন্যূনতম করের পরিমাণ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা যাচাই-বাছাই করছে এনবিআর।