নিজস্ব প্রতিবেদক: রমজান মাসে স্বাভাবিক থাকলেও পহেলা বৈশাখের পর যেন হঠাৎ করেই পেঁয়াজের ঝাঁঝ বাড়তে শুরু করেছে। নববর্ষের প্রথম সপ্তাহেই দেশের বাজারে হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা গেছে। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
পেঁয়াজের ভরা মৌসুম হঠাৎ করেই দাম বাড়ায় বিপাকে ভোক্তারা। অভিযোগ উঠেছে, ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে পেঁয়াজ মজুদের করার কারণে হঠাৎ দাম বাড়ছে। অন্যদিকে পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ক্রেতারা। এ পরিস্থিতিতে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ কমেছে ঠিকই, তবে যে হারে দাম বাড়ছে, তা অস্বাভাবিক।
আবারও বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছে, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটছে। পাইকারি, মোকাম ও আড়তে এখনই নজরদারি না বাড়ালে সামনে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।
পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। এবার পেঁয়াজের মৌসুমে উৎপাদন কম হয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে অনেক চাষি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করায় দাম বাড়ছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, পাইকারি বাজারে দামের প্রভাব খুচরা বাজারে এসেছে।
হঠাৎ পেঁয়াজের দাম উর্ধ্বমুখী বিষয়ে কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পেঁয়াজের হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যবসায়ীদের নেতিবাচক ব্যবসা চর্চার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার এবং এ খাতে মধ্যসত্ত্বভোগীদের কারসাজির অংশ। আগে ভারত থেকে পেঁয়াজ আসতে বিলম্ব হলেই এখানে দাম বেড়ে যেতো। এখন পেঁয়াজের আড়তদার, কমিশন এজেন্টস, দাদন ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কিনে মজুত করে রাখছেন। সে কারণে দাম বেড়েছে। অন্যদিকে পেঁয়াজের বাজারে কোনো তদারকি হয় না। ভোক্তা অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসন এখানে কোনো তদারকি করে না।
তিনি আরো বলেন, আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, সে কারণে কৃষক বিক্রি করতে পারলো কি পারলো না, এটা তাদের মাথাব্যথা না। আর আমাদের এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে সব সময় কোনো না কোনো পণ্য নিয়ে খেলা, অতি মুনাফা করা।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত শুক্রবার ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। তবে পহেলা বৈশাখের পরে তা এখন বাড়তে শুরু করেছে। সামনে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের। তারা জানান, দেশি পেঁয়াজের এখন ভরা মৌসুম। তবে আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যাওয়ায় হঠাৎ করেই পাইকারিতে দাম বেড়ে গেছে। ঢাকায় সব থেকে বেশি পেঁয়াজ আসে ফরিদপুর থেকে। ফরিদপুরে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার বাজারে তার প্রভাব পড়ছে।
কারওয়ানবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ কম। এবার পেঁয়াজের মৌসুমে উৎপাদন কম হয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে অনেক চাষি পেঁয়াজ সংরক্ষণ করায় দাম বাড়ছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পাইকারি বাজারে দামের প্রভাব খুচরা বাজারে এসেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি দেশি হালি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে দাম। কেন বেড়েছে জানি না। একই বাজারের আরেক পেঁয়াজ বিক্রেতা সোলাইমান বলেন, হঠাৎ করেই দাম বাড়ছে। কিন্তু এর পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। আমরা নিজেরাও জানি না কেন এমন বাড়ল।
দক্ষিণ কমলাপুর এলাকার মুদি দোকানদার আল আমিন বলেন, হঠাৎ করেই আড়তে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। গত দুই দিনে আড়তে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকার ওপরে বেড়েছে। পাইকারিতে দাম বাড়ায় আমরাও বাধ্য হয়েছি দাম বাড়াতে। কেননা, বেশি দামে কিনে তো আর কম দামে বিক্রি করা সম্ভব না। তিনি আরো বলেন, এখন পেঁয়াজের মান খুব ভালো। এই পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখা যাবে বহুদিন। আমাদের ধারণা, পেঁয়াজ ইতোমধ্যে মজুত করা শুরু হয়ে গেছে। পাইকারি মোকাম ও আড়তেও এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে হবে। তা না হলে সামনে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যাবে।
তবে আড়তদাররা জানাচ্ছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজে কৃষকরা দাম না পেয়ে লোকসান গুনেছেন। ফলে তারা হালি পেঁয়াজ সব বাজারে না ছেড়ে মজুতের দিকে ঝুঁকছেন। এতে সরবরাহ কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে আড়ত, পাইকারি ও খুচরা- সব পর্যায়েই। আরেক আড়তদার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজে এবার কৃষকরা ন্যায্য দাম পাননি। ফলে লোকসানের আশঙ্কায় অনেকেই এখনই পেঁয়াজ বিক্রি না করে মজুত করে রাখছেন। আর সেই সুযোগেই বাজারে সরবরাহ কমে গিয়ে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম সংকট। পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, কম দামে পেঁয়াজ খাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সামনে দাম আরও বাড়বে। শুক্রবার বাছাই করা পেঁয়াজের কেজি বিক্রি করেছি ৫০ টাকায়, আজ তা ৬৫ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ, পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই পেঁয়াজ কিনে মজুত করা শুরু করে দিয়েছেন। আবার খাওয়ার জন্যেও অনেকেই এখন থেকেই বেশি করে পেঁয়াজ কিনে রাখছেন। কেননা, এখন বাজারে খুব ভালো মানের শুকনো পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সহজে এই পেঁয়াজ নষ্ট হবে না। তবে পেঁয়াজের বিক্রি বেড়ে যাওয়ার কারণেই এখন দাম বাড়ছে।
পেঁয়াজের দামের হঠাৎ এই ঊর্ধ্বমুখীতায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। তাদের দাবি, বাজারে নতুন করে সিন্ডিকেট শুরু হয়েছে। পাইকারি, মোকাম ও আড়তে এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে হবে, তা না হলে সামনে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যাবে। শান্তিনগর বাজারে পেঁয়াজ কিনতে আসা সুলাইমান হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে বাছাই করা পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা করে কিনেছি। এখন তা ৬৫ টাকা কেজি চাচ্ছে। কয়দিনে পেঁয়াজার দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে গেলো। তিনি বলেন, বাজারে নতুন করে সিন্ডিকেট শুরু হয়েছে। এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে হবে, তা না হলে গত বছরের মতো এবারেও সাধারণ মানুষের পকেট কাটবে এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টদের উচিত দ্রুত বাজারে নজরদারি বাড়ানো, তা না হলে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যাবে। এর আগেও আমরা দেশে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়তে দেখেছি। এই সরকারের এখনই পেঁয়াজের বাজারে নজরদারি বাড়ানো উচিত।
বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের ঝাঁঝ
