ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা

অন্তর্বর্তী সরকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করছে; মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ব্যাংক ঋণের চাপ কমিয়ে বৈদেশিক ধারে জোর দেওয়া এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় নীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। সংশোধিত ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা আর বৈদেশিক ঋণে বাড়ছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

বেশিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও তারল্য সংকট থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা ও কৃচ্ছ সাধনে সাশ্রয়ী অর্থ ব্যয় করতে সরকার ঋণের নীতিতে পরিবর্তন আনছে।

সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ কম এবং বিদেশি ঋণ ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অর্থ বিভাগের বাজেট শাখার সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলারের জোগান এতে বাড়বে যদি বিদেশ থেকে বেশিমাত্রায় ঋণ করা যায়। কারণ, ডলার সংকট এখনো কাটেনি। বিদেশি ঋণে জোর দেওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।

সাধারণত অর্থবছরের শুরুতে সরকার একটি বাজেট ঘোষণা করে। এর মধ্যে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হলেও কম ধরা হয় আয়ে। যে কারণে ঘাটতি পূরণ করতে সরকার দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে ঋণ করে থাকে। এ বছর ঘাটতি পূরণে দেশি ও বিদেশি মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারের প্রত্যাশা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট বৈদেশিক ঋণ ৯৫ হাজার কোটি এবং ব্যাংক ঋণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা। অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে তা সংশোধন করা হয়। এতে বৈদেশিক ঋণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকায় নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৯৯ হাজার কোটি টাকায় আনা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, অন্তর্বর্তী সরকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় পরিহার করছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিচ্ছে না। এর বাইরে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পর বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ব্যাংক ঋণের, সেটির প্রয়োজনীয়তা কমছে। ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো এটি একটি কারণ। আর এটি করা হলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ বাড়বে, যা বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তিনি আরও বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার বেশি, ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় বৈদেশিক ঋণের সুদহার কম। যে কারণে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে।

অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। বিবিএস-এর হিসাবে গেল নভেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠেছে। এটি নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক হিসাবে ব্যাংক ঋণসহ সার্বিক ব্যয় কমানোর পথে হাঁটছে সরকার।

জুলাই-অক্টোবর-চার মাসে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংকসহ সঞ্চয়পত্র, বন্ড মিলে ঋণ করেছে ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছে ১৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছর একই সময়ে নেওয়া হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজস্ব আহরণ খুব বেশি সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে ছিল। বন্দরগুলো প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়ে। অর্থনীতির এ মন্থর গতির কারণে শুল্ক ও কর আদায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পড়েছে। আয় কমে যাওয়ায় এ বছর সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যায়। যদিও গত বছর এ সময়ে ঋণ না করে উলটো পরিশোধ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। ফলে অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে বর্তমান সরকার দেশের ভেতর থেকে ঋণ করা কমিয়ে আনে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংক খাত ছাড়াও এ বছর সঞ্চয়পত্র থেকে একই সময়ে ১৪ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়। আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত পালন করতে গিয়ে গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে ২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংক খাতসহ অভ্যন্তরীণ ঋণের চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার কম নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

এদিকে জোর দেওয়া হচ্ছে বৈদেশিক ঋণে। এরই মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাজেট সহায়তা হিসাবে ৬০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী জানান, প্রতিবছর ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয় বিশ্বব্যাংক। এবার সংশোধন করে আরও ৭২ কোটি ডলার বেশি দেবে। বিশ্বব্যাংক দেশের গ্যাস খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।