ভ্যাট বাড়লে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ভয়াবহ প্রভাব পড়বে

ফিরোজ আলম সুমন
১ম যুগ্ম মহাসচিব, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যায়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে বলে মনে করেন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির ১ম যুগ্ম মহাসচিব মো. ফিরোজ আলম সুমন। তিনি বলেন, এতদিন এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়া হতো। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এক ধাক্কায় ভ্যাট তিনগুণ বাড়ানো হলে ব্যবসায় ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ভ্যাটের সঙ্গে আয়করও বেড়ে যাবে। যারা সব নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা করেন, তাদের ওপরই সব সময় জুলুম হয়।

আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের প্রধান নির্বাহী এ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এসি লাগানো সৌখিনতা নয়, জরুরি। ঢাকা শহরের ৯৮ শতাংশ হোটেল, রেস্টুরেন্টে এসি রয়েছে। বিগত সরকার ১৫ থেকে কমিয়ে ১০, পরবর্তী সময়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। হার কমানোর কারণে আদায় তখন সরকারের ভ্যাট আদায় ১৯ গুণ বেড়ে যায়। আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলামÑ এটাকে ৩ শতাংশ করে দেয়া হোক, তাহলে ৫০ গুণ বেশি ভ্যাট পাবে সরকার।
সুমন বলেন, সরকারের ভ্যাট দরকারÑ তার সঙ্গে আমরা একমত, আমরা এ বিষয়ে তৈরি আছি। আমরা বলেছি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কাছে ঢাকা শহরের প্রত্যেকটা রেস্টুরেন্টের লিস্ট আছে। যৌথভাবে সমন্বয় করে সরকার কীভাবে ভ্যাট বেশি পায় সে ব্যবস্থা করা হবে। ঢাকা শহরে ২০ হাজার রেস্টুরেন্ট আছে, সবাইকে ভ্যাটের আওতায় আনতে ইএফডি মেশিন বসানো হোক। অথচ ২০ হাজার রেস্টুরেন্টের মধ্যে মাত্র ৫ শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছে ইএফডি মেশিন আছে বা তারা ভ্যাটের আওতায় আছে। আর বাকি যারা আছেÑ তারা সরকারের কর্মকর্তাদের পকেট ভারি করার জন্য এ ব্যবস্থা রাখছে। এখানে একটা বড় অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে যাদের ভালো রেস্টুরেন্টÑ ভালো খাবারের চেষ্টা করে, তারা গ্রাহক হারাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমার বলেছিলাম ইএফডি মেশিন আমাদের কিস্তিতে দেয়া হোক। এর আগেও প্রস্তাবনা দেয়া ছিলÑ আমরা কিস্তিতে সরাসরি মেশিন কিনে নিব। অর্থাৎ ভ্যাটের আওতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে চিঠি দিয়েছি। এফবিসিসিআই থেকে আশ্বাস দিয়েছেÑ আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সরকারের বর্তমান যে পরিকল্পনা তাতে কোনো সুফল বয়ে আনবে না, বরং আমাদের ব্যবসায় মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হবে। ভ্যাটের গ্রাহক না বাড়িয়ে আকার বাড়ালে এ ব্যবসা ধ্বংসের মুখে পড়বে। এর ফলে খাবারের দাম বাড়বে, মানুষের ব্যয় বাড়বে। গত ১০ বছরে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার যে বিপ্লব হয়েছে, সারা বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ ৭১ হাজার রেস্টুরেন্ট আছেÑ আমরা মনে করছি এ ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে।

বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে আগুন লাগার পরে একটি টাক্সফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সেটা কিছুটা কাজ হচ্ছিল। জুলাই আন্দোলনে কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। আমরা আশা করবÑ বর্তমান সরকার টাক্সফোর্সের আদলে ফুড সেক্টর নিয়ে ‘ফুড সেফটি’ টাক্সফোর্স গঠন করবে। আমরা একটি ছাতার নিচে আসতে চাই। এখন ৯টি সংস্থার আওতায় আছি, সেখান থেকে আমাদের একজন অভিভাবক থাকবে। বাংলাদেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যবান্ধব খাবার পরিবেশ তৈরি করতে চাই। যে খাবারে মানুষের শারীরিক কোনো ক্ষতি হবে না।

গত চার-পাঁচ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু আমরা হঠাৎ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াতে পারিনি, ফলে আমাদের ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, কয়েক মাস আগেও যে কাঁচামাল কিনতে খরচ হতো ১০ হাজার টাকা, সেই একই পণ্য কিনতে তাকে এখন প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতিতেও আমরা যদি আবার খাদ্যপণ্যের দাম বাড়াই তাহলে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব। তিনি আরো জানান, আগে প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতেন, কিন্তু বিক্রি কমায় বেতন দিতে মাসের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হচ্ছে।
ফিরোজ আলম সুমন বলেন, আমাদের দেশে ৫ শতাংশ লোকও দক্ষ নেই। অবাক করার বিষয় হচ্ছেÑ দেশে ১৭টি ফাইভস্টার হোটেল আছে, যেখানে বিদেশ থেকে এক্সিকিউটিভ সেইফ আনা হয়। এসব সেইফদের মাসে বেতন ১২ লাখ টাকার বেশি, সঙ্গে অন্যান্য সুবিধা। অর্থাৎ আমার দেশের মানুষ এতবড় সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুমন বলেন, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে রেস্টুরেন্টে কাজ করে। দক্ষতা না থাকায় তাদের অনেক কম বেতনে কাজ করেত হয়। রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছিÑ আমাদের সরকারি বা কোনো দাতা সংস্থার সহয়োগিতায় একটি ট্রেনিং সেন্টারের ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। যেখানে বিদেশে যারা যাবে তারা এখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে দক্ষ হয়ে যাবে, পাশাপাশি আমাদের দেশের কর্মীরাও ট্রেনিং নিবে। এতে করে দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে পাঠাতে পারব, বেশি ভ্যাট আসবে, সঙ্গে বেশি রেমিট্যান্সও আসবে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির (বিআরওএ) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কাজ করেন। বিআরওএর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।