সকল শ্রমিকদের জন্য শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হচ্ছে: শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক শ্রম খাতের উন্নয়নে সকল অংশীজনের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ও টেকসই উন্নয়ন সাধনে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ৩৫৩তম গভর্নিং বডি অধিবেশনে বাংলাদেশের শ্রমখাতের উন্নয়ন নিয়ে দেওয়া গতকাল এক ভাষণে মাননীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এ মন্তব্য করেন। উক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে মাননীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকীও এসময় উপস্থিত ছিলেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় বাংলাদেশের শ্রম খাতে সাধিত অগ্রগতির প্রতিবেদন তুলে ধরেন শ্রম উপদেষ্টা। গত নভেম্বরে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে দ্বিতীয়বারের মত এক্ষেত্রে অগ্রগতির উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মাননীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মামলাগুলোর অধিকাংশ বাতিল করেছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ত্রিপক্ষীয় কমিটিগুলোতে প্রকৃত শ্রমিক ও মালিক এর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে।

শ্রম উপদেষ্টা জানান, জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কাউন্সিল এর সভায় চলমান শ্রম আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে আইনটির আওতা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান ও প্রশাসনিক পদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্প্রসারণ, অন্যায্য শ্রম আচরণ ও ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্যের শাস্তি তিনগুণ বর্ধিতকরণ, শিশুশ্রমের শাস্তি পাঁচগুণ বর্ধিতকরণ, জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতা এবং জবরদস্তি শ্রমের শাস্তি নির্ধারণ, শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্তকরণ নিষিদ্ধ ও এর শাস্তির বিধান সংযোজনে ত্রিপক্ষীয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলিলাদি ও বাধ্যতামূলক সভা কমিয়ে আনা, ১০ (দশ) কার্যদিবসের মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যা প্রদানে মালিকের বাধ্যবাধকতা ও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত ইউনিয়নের সংখ্যা তিনটি থেকে পাঁচটিতে উন্নীতকরণেও সকলের ঐকমত্য হয়েছে বলে তিনি অবহিত করেন। তবে, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য ন‌্যূনতম কর্মীর শতকরা হার বা সংখ্যার বিষয়সহ কিছু বিষয়ে এখনো ঐকমত্য অর্জিত নাহলেও ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তা অর্জিত হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন। এর মাধ্যমে অচিরেই সরকার অধ্যাদেশ জারি করে আইনটির সংশোধন সুসম্পন্ন করবে বলেও তিনি জানান।

শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আরও বলেন যে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসমূহের জন্য ইপিজেড শ্রম আইন সংশোধনে অংশীজনের সাথে আলোচনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের পর বিদ্যমান ইপিজেড শ্রম আইন ও সংশোধিত বাংলাদেশ শ্রম আইনের মধ্যে ফারাক বিশ্লেষণ করে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শনের জন্য বিদ্যমান Standard Operating Procedure (SOP) অনুযায়ী শতকরা পঞ্চাশ ভাগ অঘোষিত পরিদর্শন হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিদর্শকের শূন্যপদসমূহে দ্রুত নিয়োগ দেয়া হবে।

অধিবেশনে দাখিলকৃত প্রতিবেদন নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় অংশ নিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা শ্রম অধিকার উন্নয়ন ও শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকল্পে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রশংসা করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, চলমান মামলায় গত পাঁচ বছর ধরে শুনানি অনুষ্ঠিত হলেও এবারই প্রথম সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জোট হিসেবে প্রথমবারের মত আরব দেশগুলোর জোট বাংলাদেশের পক্ষে জোটবদ্ধ অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে চলমান দেশগুলোর ক্ষেত্রে কোনো জোটের এমন সমর্থন একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। আরব জোট ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে ১৮টি দেশ বাংলাদেশের চলমান শ্রম সংস্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেন যা এযাবৎকালে অর্জিত সর্বোচ্চ সমর্থন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা শ্রমখাতে সংস্কারে সরকারের চলমান উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানান এবং এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। উল্লেখ্য, চলতি অধিবেশনে গভর্নিং বডির কোনো সদস্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দাবি জানায়নি। বাংলাদেশের দাখিলকৃত প্রতিবেদন ও অধিবেশনে অনুষ্ঠিত আলোচনার ভিত্তিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে সহযোগিতার উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান মামলার বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা নভেম্বর ২০২৫ এর পরিবর্তে আগামী বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে আন্তর্জাতিক মহলের অব্যাহত সহযোগিতার প্রশংসা করেন এবং এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তনিও গুতেরেজের চলমান শুভেচ্ছা সফরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তাছাড়া শ্রম উপদেষ্টা শ্রমখাতের উন্নয়নে সরকারের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ত্রিপক্ষীয় দলসহ যেকোনো প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান। সমাপনী বক্তব্যে তিনি চলমান মামলাটি শীঘ্রই নিষ্পত্তি করতে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন কামনা করেন।

শ্রম উপদেষ্টা অধিবেশন পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সেক্রেটারি জেনারেলের সাথে একান্ত বৈঠক করেন এবং জানান যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এর নেতৃত্বে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। শ্রমিক পক্ষ, মালিক পক্ষ ও সরকার পক্ষ সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কাউন্সিল শ্রমিকদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বৈঠক শেষে শ্রম উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সেক্রেটারি জেনারেলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।