সাত বছর পর সভামঞ্চে আসছেন খালেদা জিয়া

দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর আবারও সভামঞ্চে বক্তব্য দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আগামী ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন বিএনপিপ্রধান। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে দেড় থেকে দুই হাজারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত থাকবেন। এ বিষয়ে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে মুক্তিযোদ্ধা দল। এরই মধ্যে খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সমাবেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি তার শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এর আগে সর্বশেষ ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও কোনো বক্তব্য দেননি বিএনপি চেয়ারপারসন।

মুক্তিযোদ্ধা দলের কয়েকজন নেতা গতকাল শনিবার বলেন, মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আমরা সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবকিছু ঠিক থাকলে সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এ বিষয়ে যাবতীয় প্রস্তুতি নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করা হবে। তারা বলেন, এবার ভিন্ন আবহে এবং মুক্ত পরিবেশে একটি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ হতে যাচ্ছে। অতীতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ঠিকমতো সভা-সমাবেশ করা যায়নি। কিন্তু ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে এক নতুন আবহ ফিরে এসেছে। এখন আগের মতো হামলা-মামলা ও হয়রানিার শঙ্কা নেই। সেজন্য আগামী ২১ ডিসেম্বরের সমাবেশে সারা দেশ থেকে দেড় থেকে দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে আগামী ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে জেনেছি। শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকলে সেখানে বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ইনশাআল্লাহ।

সীমান্তবর্তী দুই জেলায় সমাবেশ আগামী সপ্তাহে: এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ ও অবস্থানের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি দলটির নেতাকর্মীদের বক্তব্য ও কিছু পদক্ষেপে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এখন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দেশের জনগণকে সচেতন ও জাগ্রত করার লক্ষ্যে সীমান্তবর্তী দুই জেলা পঞ্চগড় ও জামালপুরে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই বিএনপিতে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। কিন্তু কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের এক ধরনের সমঝোতা হতে পারে—এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও বাস্তবে সে ধরনের কোনো কিছু দেখা যায়নি। বিএনপির তিন সংগঠনে ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে পদযাত্রা ও স্মারকলিপি এবং আগরতলা অভিমুখে লংমার্চ করে বিএনপি দেশটিকে এক ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। দলটির একাধিক নেতা মনে করেন, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের সমর্থনের কড়া জবাব এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে বিএনপি দল-মত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ—এ দুটি বিষয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপির ভারতবিরোধী দৃঢ় অবস্থান জনগণ ও বিদেশিদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লাগামহীন অপপ্রচার (প্রোপাগান্ডা) ছড়াচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত ছাত্র-জনতার সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে তারা ক্রমাগত ভিত্তিহীন এবং কল্পনাপ্রসূত খবর প্রচার করছে। তাদের অপপ্রচার এবং গুজবের কারণে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের অব্যাহত নেতিবাচক আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বিএনপি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করছে। নেতাদের আরও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কী করে একটি বিশেষ দল ও ব্যক্তির জন্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ কয়েকটি বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। বৈঠকে নেতারা বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘিরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, এর পেছনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার ভূমিকা রয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে অস্থিরতা তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি বলছে, তারা একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুত্ব চায়, অন্যদিকে তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকবে। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথকভাবে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বৈঠকও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। এই বৈঠক এমন সময় হয়েছে, যখন বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব দৃঢ় হয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এটি বিশেষ মেরূকরণ বলেও মনে করা হচ্ছে।

বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল বলেন, ভিয়েনা কনভেনশনের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী কূটনীতিকদের সুরক্ষা দিতে ভারত সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আগরতলা এবং কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশন ও সহকারী হাইকমিশনে যেভাবে হামলা করে জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রচণ্ড আঘাত। এ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর কথা বলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অবমাননা করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তো চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগামী ১৯ ডিসেম্বর জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় সমাবেশ করবে বিএনপি। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এরপর ২২ ডিসেম্বর সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার সাকোয়া হাই স্কুল মাঠ প্রাঙ্গণে সমাবেশ করবে বিএনপি। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরই মধ্যে বোদা উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ সব অঙ্গসহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে প্রস্তুতি সভা হয়েছে। পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, বোদা উপজেলার ঐতিহাসিক সাকোয়া হাই স্কুল মাঠে জনসভা সফল করার লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, লক্ষাধিক লোকসমাগম হবে।