ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা বন্ধে তিন বিশ্বনেতার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন প্রবাসীসহ ২০১ বাংলাদেশি বিশিষ্টজন।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নেটওয়ার্কের ব্যানারে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রবার্টা মেতসোলা ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার তুর্ক বরাবর এ আবেদন করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, আমরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিকল্পিত ও চলমান হত্যার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছি। ভারতীয় বাহিনীর ক্রমবর্ধমান সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সীমা ছাড়িয়েছে এবং এভাবে ভারত জাতীয় সার্বভৌমত্বের নীতির প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে।
‘বছর কয়েক আগে মাত্র ১৫ বছর বয়সী কিশোরী ফেলানী খাতুনকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা তার লাশ বিএসএফের নির্মমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফেলানীর মর্মান্তিক মৃত্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দার ঝড় তুলেছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত সীমান্তে হত্যার মিছিল থামাতে পারেনি। গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে, মাত্র গত সপ্তাহে (৯ সেপ্টেম্বর) আরও একজন ১৫ বছর বয়সী কিশোর জয়ন্ত কুমার সিংহ খুন হয়েছে, আরও একটি নিষ্পাপ জীবন বর্বর ভারতীয় বাহিনীর হাতে থেমে গিয়েছে। এই তালিকায় আছে ১ সেপ্টেম্বরে বিসিএফের গুলিতে খুন হওয়া ১৩ বছর বয়সী কিশোরী স্বর্ণা দাস ও গত মাসের ১২ তারিখে একইভাবে খুন হওয়া আবদুল্লাহ।’
আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানাচ্ছে, কেবল ২০২৩ সালে বিএসএফ সীমান্তে গুলি অথবা নির্যাতন করে ৩১ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এর আগে ২০২১ সালে ১৮ জন এবং ২০২২ সালে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আসকের মতে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিএসএফ-এর নৃশংসতায় অন্তত ৫২২ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। লক্ষণীয় যে, কোভিড মহামারির সময়কালেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি।
ভারতীয় দণ্ডবিধি বা অন্য যেকোনো আন্তর্জাতিক আইন চোরাচালানিদেরও ইচ্ছামতো গুলি করে হত্যা করার অনুমতি দেয় না; বরং রাষ্ট্রের মাধ্যমে সীমান্ত পেরোনো ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলে। ভারত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ আইন এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলি নিয়মিত উপেক্ষা করে, যেমন ১৯৭৫ সালে গৃহীত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সীমান্ত কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা এবং ২০১১ সালের ভারত-বাংলাদেশ সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা।
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ নির্দেশিকার ধারা ৮(ক) এ বিষয়টি জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার পরিহার করতে হবে। ৮(দ) ধারায় গবাদি পশু চোরাচালান ঠেকাতে পার্শ্ববর্তী দেশের থানায় জানানোর কথা বলা হয়েছে, যাতে সহিংসতা ছাড়াই চোরাইকৃত পশু এবং সন্দেহভাজনদের উদ্ধার এবং আটক করা যায়। তবে বিএসএফ যে এই প্রোটোকলগুলি পালনে ব্যর্থ তা দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ট্রিগার হ্যাপি: বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ’ [সূত্র ০১] শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বিএসএফের হত্যার শিকার ব্যক্তিরা অধিকাংশই নিরস্ত্র বা সামান্য অস্ত্রধারী ছিলেন, অনেকেই পালিয়ে যাওয়ার সময় পেছনে গুলি খেয়েছিলেন বা তাদের সামান্য দূরত্ব থেকে আঘাত করে হত্যা করা হয়। কোনো তদন্তেও এমন কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য পাওয়া যায়নি যাতে মনে হয় আত্মরক্ষার জন্য এই অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার সমর্থনযোগ্য। তাছাড়া নিরস্ত্র ব্যক্তিরা বিশেষ করে ফেলানী এবং স্বর্ণার মতো কিশোরীরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিএসএফ সদস্যদের জন্য বিপদ হতে পারে এমন ধারণা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
খোলা চিঠিতে আরও বলা হয়, এসব মোটেই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এই ঘটনাগুলি দায়মুক্তির ও আগ্রাসনের এক উদ্বেগজনক পরম্পরাকেই উন্মোচন করে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিক ও গুরুতর উদাহরণ। সীমান্তে জীবনের এমন ক্রমাগত পরাজয় নাগরিক হিসেবে আমাদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য স্পষ্টতই হুমকি।
‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই যে তারা এই নৃশংসতাগুলি মোকাবিলা করুক এবং যারা এর জন্য দায়ী তাদের তাদের কর্মের জন্য জবাবদিহি করুক। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের মতো সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করা ও নিন্দা জানানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আহবান জানাই, এই নৃশংসতা বন্ধ করতে আপনাদের প্রভাব ব্যবহারের মাধ্যমে অবিলম্বে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করুন, এবং ভবিষ্যতেও এরকম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে আপনাদের ক্ষমতার মধ্য থেকে যেভাবে সম্ভব ভূমিকা রাখুন।
বিশিষ্টজনদের এই খোলা চিঠিতে বলা হয়, নিরপরাধদের কান্না অশ্রুত থাকবে না- তা কেবল আমরা সম্মিলিতভাবেই নিশ্চিত করতে পারি। এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নীরবতা ভাঙা দরকার। বাংলাদেশের সীমান্তে এই রক্তপাত বিশ্ব উপেক্ষা করতে পারে না। এই সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক সংলাপ ও পদক্ষেপের সামনে আনার সময় এসেছে।